• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছে ছোট্ট বীথি

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী বীথি

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছে ছোট্ট বীথি

  • প্রকাশিত ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী বীথির কাছে বাবার মুখটিও এখন অস্পষ্ট। মা থেকেও নেই। স্কুলে, রাস্তায় যখন কোনো বাবা-মা শিশুকে আদর করতে দেখে, তখন এক পলকে চেয়ে থাকে বীথি। কষ্টে তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই। বৃদ্ধ নানা-নানিকে দু’মুঠো খাবারের জন্য সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হয় কখনো মাঠে, কখনো অন্যের বাড়িতে। তাই মাত্র নয় বছর বয়সেই একাকী বীথি বাবা-মায়ের আদর-স্নেহের হাহাকার, কষ্ট ও যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা করে পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে নানি সেতারা বেগম ও নানা হানিফ মাতুব্বরের আদর-স্নেহে বেড়ে উঠছে বীথি ও তার স্বপ্ন। হাজী আফসার উদ্দিন মুন্সী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার দ্বিতীয় শ্রেণির এ ছাত্রীর বাবা মোক্তার হোসেন যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, তখন বীথির বয়স মাত্র চার। বাবার মৃত্যুর শোক না ভুলতেই এক বছরের মাথায় বীথিকে নানার কাছে রেখে মা লাইলী বেগম দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যায়।

সদা হাস্যোজ্জ্বল মায়াবী বীথির মুখটি সন্তান কোলে কোনো বাবা-মাকে আদর করতে দেখলেই অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে যায়। বুকের চাপা কান্নায় স্রোত ঝরে দু’চোখে। সরেজমিনে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় বীথির এ কষ্ট যন্ত্রণার মুখচ্ছবি।

বীথির ভাষায়, ‘মায়ের কাছে আমি তো বোঝা। আব্বায় মরার পর মাও জানি ক্যামন হইয়া গ্যাছে। হেইয়ার লাইগ্যা আমারে হালাইয়া (ফেলে রেখে) থুইয়া গ্যাছে। কবে যে মায়ের কোলে বইয়া ভাত খাইছি, ঘুমাইছি কিছু মনে নাই। আমাগো বাড়িঘর সবই ছিল। হেই বাড়িতে এ্যাহন কেডা থাহে জানি না। বাড়িডা ক্যামন মনে নাই।’ অথচ একসময় সুখের সংসার ছিল বীথিদের। একথা বলেন মাদরাসার ক্বারি শিক্ষক মো. এরশাদুল্লাহ।

এখন পাঠ্যবই হলো বীথির কাছে বাবা-মায়ের না পাওয়া ভালোবাসা। মাদরাসার ছুটি শেষে সারাদিন ঘরে বসে বই পড়েই সময় কাটে তার। পাঠ্যবইয়ে বাবা-মা ও সন্তানের প্রতীকী ছবি দেখলেও কেঁদে ওঠে বীথি। বীথি জানায়, নানা-নানি আমারে নিয়ে যে কষ্ট করছে, লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে এ বৃদ্ধ নানা-নানির পাশে দাঁড়াতে চাই। মায়ের অবহেলা ও ভালোবাসার অভাব তাকে কখনো নানা-নানি বুঝতে দেয়নি।

বীথির নানি সেতারা বেগম বলেন, ‘বীথির বাবা মইর্যা যাওনের পর একটা বছর মাইয়ারে নিয়া অর মায় (লাইলী বেগম) ঢাকায় ছিল। হেইয়ানে হারাদিন নাতনিডারে ঘরে তালা দিয়া থুইয়া কামে যাইতো লাইলী। তহন অর বয়স চাইর বছর। ছোট্ট নাতনিডা হারাদিন কানতো (কাঁদতো)। এই খবর মাইনষের কাছে হুইন্না অরে আমরা লইয়া আই।’

তিনি বলেন, বীথির বাপটা মরার পর চাচারাও কেউ খোঁজ নেয় না। মাইয়াডা পড়তে চায়, মাদরাসায় যাইতে চায়। আমাগো তো প্যাট (পেট) চালাইন্নাই (খাবার খাওয়া) কষ্ট। হ্যার পরও মাইয়াডারে ভর্তি করছি। খাতা-কলম কিইন্না দিতে পারি না। মাদরাসা থেকে কিছু দেয়। বাকিডা মাইনষের ধারে চাইয়াচিন্তা (চেয়ে) লই। ঈদ যায়, কোরবানি যায় অরে না কিইন্না দেতে পারি নতুন জামা, না খাওয়াইতে পারি একটু গোশত। নাতনিডার এ্যাতে কোনো দুঃখ নাই, আপসোস নাই। ও চায় খালি ল্যাহাপড়া করতে। আমরা বুড়া হইয়া গ্যাছি। কয়দিনই আর বাঁচুম। আমরা যতদিন বাঁইচা আছি ততদিন তো অরে পড়ামু। কিন্তু হেইয়ার পর কে দ্যাখবে অরে। অর তো বাবা নাই। মা থাইক্কাও নাই। এ কথা বলেই কেঁদে ফেলেন সেতারা বেগম।

মাদরাসা সুপার মাওলানা মো. নেছারউদ্দিন জানান, মাদরাসা থেকে অসহায় দুস্থদের বইখাতা দেওয়া হয় এবং অবৈতনিক। বীথিকেও তারা সাধ্যমতো সহায়তা করছেন। মেয়েটা এতিম এবং খুবই মেধাবী। তাকে যদি কেউ সহায়তা করে, তাহলেই কেবল সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে। কেননা বৃদ্ধ নানা-নানিই এখন তার শেষ সম্বল ও বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads