• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
চাঁদের হাসিতে হাসছে উপকূল

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

চাঁদের হাসিতে হাসছে উপকূল

  • মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

ওরাও এখন স্বপ্ন দেখে আগামীর। যেখানে থাকবে না ‘অক্ষর’ না জানার অভিশাপ। ঘরের পড়ার টেবিলে রাখা জাল, কোদাল, খোন্তা সরিয়ে অভিভাবকরা সেখানে সাজিয়ে রাখতে চান মোটা মোটা বই। যে বই পড়ার সৌভাগ্য তাদের হয়নি, সেই বইয়ের প্রতিটি পাতার গল্প শুনতে চান সন্তানের মুখে। নিরক্ষতার অভিশাপ মুক্ত করতে চান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এ স্বপ্ন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অবহেলিত সাগর ঘেঁষা পশ্চিম চাপলী গ্রামের পিছিয়ে পড়া জেলে জনগোষ্ঠীর। এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। গত নয় বছরে ‘চাঁদের হাসি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’র শিক্ষাপ্রীতি পাল্টে দিয়েছে এ গ্রামের অভিভাবকদের শিক্ষাভীতি। ‘কাজ নয়, শিক্ষাই গড়ে দেবে ভবিষ্যৎ’- এ স্লোগানে উদ্ধুদ্ধ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অভিভাবকদের আন্তরিকতায় এখন এখানকার প্রতিটি শিশু স্কুলমুখী। চাঁদের হাসিতে হাসছে উপকূল, বপন হচ্ছে আগামীর স্বপ্ন।

শুরুটা ২০০৮ সালে। ২০০৭ সালে সিডর বিধ্বস্ত কলাপাড়ার উপকূলের মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিল উন্নয়ন সংস্থা এফএইচ। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অভিভাবকদের অসচেতনতায় তখন ‘শিক্ষা দুর্ভিক্ষ’  উপকূলের সিডর থাবায় বিধ্বস্ত প্রতিটি পরিবারে। এ শিক্ষা দুর্ভিক্ষ থেকে শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে কলাপাড়ায় ধুলাসার ইউনিয়নে চারটি ও নীলগঞ্জ ইউনিয়নে তিনটি মোট সাতটি ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’ গড়ে তোলা হয়। তাদের আন্তরিকতায় গত নয় বছরে এ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার শিশু এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত।

‘চাঁদের হাসি, শিশুকুঞ্জ, দিগন্ত, কাউয়ার চর, সোনামনি, বন্ধন ও গোলাপ’ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র উপকূলের শিশুদের প্রি-স্কুল। উপকূলের যে অভিভাবকরা এত বছর শিশুদের শিক্ষার পরিবর্তে শৈশবেই নানা কর্মের তালিম দিত, সেই অভিভাবকদের সচেতন করে তাদের সন্তানদেরই অক্ষর শিখিয়ে স্কুলগামী করতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কাজ করছে। কলাপাড়া সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সাগর ঘেঁষা একটি গ্রাম পশ্চিম চাপলী। শহরের উন্নয়ন ছোঁয়ার ছিটিফোঁটাও নেই এখানে। এখনো সঙ্কট বিশুদ্ধ পানির। গ্রামীণ এবড়োখেবড়ো রাস্তা। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারে ঢেকে যায় গোটা গ্রাম। সেই অন্ধকারে চাঁদের হাসি শিক্ষার আলোতে আলোকিত করছে এখন গোটা গ্রাম। গত নয় বছরে শুধু এ গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ঝরে পড়া দুই শতাধিক শিশু এখন স্কুলগামী। চাঁদের হাসি’তে গিয়ে দেখা যায়, কেউ পড়ছে অ আ কেউবা ছড়া। কেউ আবার গুনছে এক, দুই কেউবা পড়ছে বারো মাসের নাম। হাসি-আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে চার-পাঁচ বছরের এ শিশুরা পড়ালেখায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। অথচ মাত্র নয় বছর আগে এই বয়সী শিশুরা কেউ মাঠে ধান কুড়াত, কেউবা বাবা-মায়ের সাথে যেত বর্গা খাটতে।

পাঁচ বছরের ইউনুস। তার জন্মের সময়েই মায়ের মৃত্যুর পর খালার কাছে থেকে বড় হচ্ছে। বাবা দিনমজুর সালাম মোল্লা দ্বিতীয় বিয়ে করে এখন সংসার করছে। এ চাঁদের হাসিতে ইউনুস প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে  শিক্ষা নিচ্ছে। আদর্শ লিপি শেষ হয়েছে। এবার স্কুলে ভর্তি হবে সে। এ শিক্ষা কেন্দ্রের সেবিকা (শিক্ষিকা) নিপুণ আক্তার জানান, এ নতুন বছর ১৯ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। মাসিক মাত্র ২০ টাকায় তাদের স্কুলগামী করে তোলা হচ্ছে। শিশু জিদনী, সাহাদাত, জান্নাতী, রিয়াজ, মাছুমও এখানকার শিক্ষার্থী। বাবা-মা অক্ষর না চিনলেও মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সেই ওরা গলা ছেড়ে আবৃত্তি করছে ছড়া, কবিতা। বর্ণমালা দেখে শব্দ তৈরি, কিংবা ইংরেজি সপ্তাহ, মাসের নামও বলে দিচ্ছে। সন্তানের এ শিক্ষার আগ্রহ কাছ থেকে দেখে আনন্দে চোখের জল ফেলছে অভিভাবকরা।

শিশু শিক্ষার্থী লিজা (৫)। জেলে মো. লিটনের ছোট মেয়ে। আরো তিন সন্তান আছে তার। তাদের কাউকেই স্কুলে ভর্তি করতে পারেন নি আর্থিক দৈন্যতায়। গ্রামের স্কুলের পাশ দিয়ে যখন যেতেন তখন তার চোখে জল চলে আসত নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। তাই ছোট মেয়ে লিজাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন নিয়ে এ চাঁদের হাসিতে ভর্তি করিয়েছেন।

ট্রলার শ্রমিক মো. ইউসুফেরও চার সন্তান। নিজের অক্ষর জ্ঞান নেই। আর্থিক দৈন্যতায় তিন সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারেন নি। তিনিও ছোট মেয়ে সুমাইয়াকে চাঁদের হাসিতে নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘মোরা কাম করছি প্যাডের খিদায়। ঘরের টেবিলে কোনোদিন বই খাতা দেহি নাই। হারা ঘরে আছিল জালের কাডি, লাঙ্গলের ফাল, খোন্তা-কোদাল। এই মাইয়ারে ল্যাহাপড়া করামু। ঘরের টেবিলে এ্যাহন বই সাজামু। মোডা (মোটা), মোডা বই থাকবে। মাইয়ায় বড় হইয়া হেই বইয়ের গল্প মোগো হুনাইবে।’ এভাবে সাতটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে দুই শতাধিক শিশুর অভিভাবক এখন থেকেই দেখছে আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

এফএইচ’র শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের টিম লিডার আসাদুল ইসলাম জানান, স্কুল ঘর তৈরি থেকে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ  করা হয় তাদের সংস্থা থেকে। এ ছাড়া প্রতিটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে চক, শ্লেট, শিক্ষার ফ্লিপচার্ট ও খেলায় খেলায় শিক্ষা ও জানার জন্য খেলার উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের লক্ষ্য গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা যাতে স্বাবলম্বী পরিবারের শিশুদের থেকে পিছিয়ে না পড়ে এজন্য শিক্ষায় মনোযোগী করে তোলা। এফএইচ’র এরিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর গৌতম দাস জানান, ২০০৮ সাল থেকে কলাপাড়ায় সাতটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে গত ১০ বছরে কয়েক হাজার শিশু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে। গ্রামে নিশ্চিত ঝড়ে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করে তোলাই তাদের সাফল্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads