• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সেবার মানসিকতায় অনন্য কুটিলা রিছিল

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

সেবার মানসিকতায় অনন্য কুটিলা রিছিল

  • হাবিবুর রহমান, মধুপুর (টাঙ্গাইল)
  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পাহাড়িয়া লাল মাটি অধ্যুষিত এলাকায় ১৭ বছর যাবৎ সামান্য সম্মানীতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন কুটিলা রিছিল। সূর্যের হাসি ক্লিনিক ও কমিউনিটিকে সেবিকা হয়ে তিনি মোটিভেশনাল কাজ করছেন হাসিমুখে। অভাব অনটনের সংসারে পেটে ভাত না থাকলেও সেবার মানসিকতা নিয়ে ২০০১ সাল থেকে নিজ গ্রামেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তার গ্রামের শিশুস্বাস্থ্য কিংবা গর্ভবতী মায়েদের টিকা ও সন্তান প্রসবকালীন পাশে থাকেন। যদি সন্তান প্রসবের সময় হয় তখন রোগীকে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে নিতে তিনি সঙ্গে থাকেন। পাশে দাঁড়ান। খুশি হয়ে কেউ কিছু হাতে দিলে নেন। এভাবে ২০০১ সাল থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন কুটিলা রিছিল। বয়স ৩৯ বছর। বাবা গারো প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অনাথ সাংমা। মায়ের নাম জারি রিছিল। স্বামী পবিত্র আতিওয়ারা। বাড়ি মধুপুর উপজেলার বেরিবাইদ গ্রামে।

সংসারে অভাব থাকার কারণে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পাট চুকিয়ে যায়। ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। আবাদ করার মতো কোনো জমিজমা নেই। বাড়ি ভিটিটুকু সম্বল। ১ বিঘার মতো জমি আছে। অভাবের সংসার। সংসার জীবনে ৩ ছেলে, মেয়ে নেই। বড় ছেলে কেলবিন রিছিল (২৫) ঢাকায় সেলুনে কাজ করে। মেজো ছেলে অলড্রিন রিছিল (২৩) ঢাকায় বাসায় কাজ করে। ছোট ছেলে মুকলি রিছিল (১৭) বাড়িতে থেকেই দিনমজুরের কাজ করে। স্বামী পবিত্র আতিওয়ারা ঢাকায় অন্যের বাসায় কেয়ার টেকারের কাজ করেন। সংসারে সবাই শ্রমজীবী। কাজ না করলে ভাতের সন্ধান মেলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

২০০১ সালের অক্টোবরের কথা। স্বাস্থ্য সহকারী জীবন শঙ্কর তাদের বেরিবাইদ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিতেন। তার উৎসাহে সাহায্যকারী এলাকায় ইপিআর, গর্ভবতী মায়ের টিকা ও অন্যান্য সেবা মায়েদের চেকআপসহ নানা কাজে তার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তারপর বেসরকারি সূর্যের হাসি ক্লিনিকে কাজ শুরু করেন। প্রোভাইডার হিসেবে পান কোম্পানির ওষুধের সহযোগিতা। এভাবে বেরিবাইদ কমিউনিটি ক্লিনিকে সাহায্যকারী হিসেবে ঘর ঝাড়ু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মোটিভেশনসহ ক্লিনিকের সিএইচসিপি-এর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বেরিবাইদ কমিউনিটি ক্লিনিকে ও সূর্যের হাসি ক্লিনিক থেকে মাসে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা হাতখরচ হিসেবে পান। কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত সিএইচসিপি শুক্লা আতিওয়ারা তার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে মাসে ৪০০-৫০০ টাকা দিয়ে থাকেন। সূর্যের হাসি থেকে ২০০-৩০০ টাকা পান। সর্বসাকুল্যে মাস শেষে তার আয় ১৫০০-১৬০০ টাকা।

কুটিলার মতে পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার হার কম। মানুষ সচেতন কম। শিশু ও মায়ের যত্ন বোঝে না। সময়মতো টিকা নিতে চায় না। স্বাস্থ্য সহকারীদের সাহায্যকারী হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করা। শিশুদের ও মায়ের যত্ন নেওয়াসহ নানা বিষয়ে তিনি মোটিভেশন দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, সেবার মানসিকতা থেকেই সেবা করি। কারণ সেবাই পরমধর্ম।

বেরিবাইদ কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত সিএইচসিপি শুক্লা আতিওয়ারা জানান, কুটিলা অনেক ভালো সেবিকা। তার সেবার মানসিকতা প্রকট। সে আমাকে সাহায্য করে। ক্লিনিকে পিয়ন নেই। একা ক্লিনিক চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এজন্য আমি তাকে সাহায্যকারী হিসেবে রেখেছি। মাসে ৫০০-৬০০ টাকা সম্মানী দিয়ে থাকে বলে জানান। এ সম্মানী তার ব্যক্তিগত।

কুটিলা রিছিল জানান, তার শরীর ভালো না। রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত। টাকার অভাবে দুধ, ডিম, মাছ-মাংস, পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে তবুও ১৭ বছর যাবৎ সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি জানান, যতদিন শরীর ভালো থাকবে ততদিন সেবা দিয়ে যাব। শরীর ভালো না থাকলে তো আর সেবা দিতে পারব না। রক্তশূন্যতার কারণে শরীর ভালো যাচ্ছে না। দুর্বল শরীর নিয়ে কী করব। টাকার অভাবে ভালো খেতে পারি না। ঈশ্বর আমাদের মতো গরিবদের ভরসা। তারপরও নেই তার কোনো আপসোস, নেই কোনো অনুশোচনা, আছে দেশপ্রেম আর সেবার মানসিকতা। সারা জীবন সেবা করার বাসনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads