• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সাহিত্য ও সংস্কৃতি

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

জয়পুরহাট জেলায় অনেক আগে থেকে গ্রামীণ বা লোকজসমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। ব্রিটিশ শাসনামলে কীর্তন, জারি, পালাগান, কবিগান, বাউল, মুর্শিদী, লোকগীতি, ভাওয়াইয়া, যাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠান হতো নানা উৎসব উপলক্ষে। তখন বর্ষায় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার গান অনুষ্ঠানও উপভোগ করতেন নদীতীরের মানুষ। সারা রাত জেগে জ্যোৎস্নারাতে লোকজন পুঁথিপাঠ, পাঁচটাকার কিসমা (রাত চুক্তিতে গল্পকথা) শুনতেন। রংপুর ও দিনাজপুরের দক্ষিণাংশে এই জেলা ভাওয়াইয়া গানের প্রভাবাধীন। আগে জমিদার বা ধনাঢ্য জোতদার ব্যক্তিরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গ্রামীণ খেলাধুলাও চলত সমানতালে। দেশবিভাগের পর লোকজ সংস্কৃতির ধারাটি ধীর ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। যাত্রা চললেও তরুণ সমাজে নাটক (থিয়েটার) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর ও ক্ষেতলালে নাটকের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা সদরসহ উপজেলা পর্যায়েও অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তবে পৃষ্ঠপোষকতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত মূল সংগঠক বা কর্মীর জীবন-জীবিকা ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ততার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো সক্রিয় নয় (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। অর্থাভাব, সরকারি সহযোগিতার অভাব ও পরিবেশের কারণেও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা কমে যায়। কোনো কোনোটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জেলা সদরে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রতিদিন চালিয়ে যাচ্ছে সাধ্যমতো। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ সঙ্গীত (বিভিন্ন বিষয়ে) ও নৃত্যের একাধিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা করে চলেছে। ২০০৮ সালের মার্চে (১৪-১৬ মার্চ) তিন দিনব্যাপী ২৭তম জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সফলভাবে। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ জয়পুরহাট জেলা শাখা স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগণ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় সাড়া জাগানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই সম্মেলনে জাতীয় পর্যায়ের বরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদসহ প্রায় সব জেলার শিল্পীরা অংশ নেন। জাতীয় দিবসগুলোতে জেলা শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, গ্রাম থিয়েটার, ফুলকি, সারগাম, বাউল, আবৃত্তি পরিষদ, শামিতনগর গ্রাম থিয়েটার, মানবাধিকার নাট্য পরিষদ, খেলাঘর আসর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

 

ভাষা : জয়পুরহাট জেলাব্যাপী সুনির্দিষ্ট কোনো নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা নেই। আনুমানিক দশ মাইল পরপর ভাষার পার্থক্য কমবেশি বোঝা যায়। জয়পুরহাট ও পাঁচবিবির পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে প্রায় এক ধরনের আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত, যেমন- তুই ভাত খালু (তুমি/তুই ভাত খেয়েছ/খেয়েছিস)? আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল ও কালাই উপজেলার মানুষ একটু টেনে কথা বলেন। এখানে বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব দেখা যায়, যেমন- তুই কোটে যাচ্ছু বারে (তুই কোথায় যাচ্ছিস)? এখানে বারে শব্দটি যেন অলঙ্কার, কোনো অর্থ বহন করে না। তবে শিক্ষিতদের একাংশ চলিত ভাষায় কথা বলে (এদের সংখ্যা কম)।

 

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় জ্ঞান-গরিমার কেন্দ্রভূমি মহাস্থান এবং গৌরীয় সভ্যতার পরশধন্য জয়পুরহাটে আবির্ভূত হয়েছেন অনেক কবি-সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের উন্মেষকালের কবি জয়দেব গোস্বামী এই জয়পুরহাটেরই কৃতী সন্তান। জয়পুরহাট সদর উপজেলার কেন্দুইল গ্রামে কবি জয়দেবের জন্ম। কবি জয়দেব গোস্বামী ছিলেন গোটা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কবি। তা ছাড়া কবি আরিফ সাহা এবং কবি সরকার (ছদ্মনাম)-এর পুঁথি সাহিত্যের জন্য ব্যাপক খ্যাতি ছিল।

 

জয়দেব গোস্বামী : বাংলা সাহিত্যের উন্মেষকাল থেকেই জয়পুরহাটের কবি-সাহিত্যিকরা নানাভাবে সাহিত্য-শিল্পকে সমৃদ্ধ করে আসছেন। প্রাচীনকালে যে কয়জন বাঙালি কবির আবির্ভাব, বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব গোস্বামী তাদের অন্যতম। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি জয়দেব গোস্বামী জয়পুরহাট সদর উপজেলার কেন্দুইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবি জয়দেব রচিত শ্লোক, প্রণমামি শিবং শিবঃ কল্প তরুস্ কেশবঃ ধৃতংহ মীনঃ শরীরঃ কেণবঃ ধৃতং নরহরি রূপম জয় জয় দেবহরে, - হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, আজো বাংলা ভারতের হিন্দু নরনারী শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাঠ করে থাকে। বৈষ্ণব আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম রচনা গীতগোবিন্দ কবি জয়দেবের অমর কীর্তি।

 

কবি সরকার (ছদ্মনাম) : কবি সরকার ছদ্মনামে পরিচিত এই কবির জন্ম ক্ষেতলাল উপজেলায়। তিনি বাদল মণ্ডলের পুঁথি নামের একটি পুঁথি সাহিত্যের রচয়িতা। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে রচিত এই পুঁথি সাহিত্য জেলার গ্রামাঞ্চলে আজো অনেকের ঘরে রক্ষিত আছে।

 

আরিফ সাহা : বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কবি আরিফ মামুদ সাহা রচিত হরিদাশের পুঁথি হাতে লেখা আকারে আজো গ্রামাঞ্চলে অনেকে পাঠ করেন। কুজাইল করিমপুর (ক্ষেতলাল) আরিফ সাহার জন্মস্থান বলে জানা যায়। তিনি বামনগাঁও পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন। তার পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত হরাদাসের পুঁথি একসময় গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে পাঠ করা হতো। তার রচনার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাহিনিকে নিখুঁতভাবে কাব্যাকারে ফুটিয়ে তোলা। হরাদাসের পুঁথিতে জমিদারের প্রজা পীড়নের চিত্র ও হরাদাসের পুত্র পুণ্যের মর্মান্তিক মৃত্যুকাহিনি চিত্রিত হয়েছে।

 

জসীম উদ্দীন মুন্সী : জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভাদশা গ্রামে ১৮৭০ সালে জসীম উদ্দীন মুন্সী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম প্রচারক ও বিশিষ্ট বাগ্মী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসন আমলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজের ধর্মবিমুখ মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইসলাম প্রচার করতেন। তার রচিত ‘নছিহতে ফুচ্ছাক’ নামক ধর্মীয় গ্রন্থটি কলকাতা থেকে ছাপা হয়েছিল। দেশবিভাগের আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

 

সাম্প্রতিককালে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে জসীম উদ্দীন মুন্সী, আতাউর রহমান, ড. জাহাঙ্গীর চৌধুরী, আব্বাছ আলী খান, মহসীন আলী দেওয়ান, সাহাদৎ হোসাইন, মোজাহার হোসেন জামালী, এস এম আনছার আলী, নাট্যকার মো. আলাউদ্দিন, রেজাউল করিম, শচীন্দ্রনাথ বর্মন, তহুরা বেগম, সৈয়দ এমদাদ আলী দেওয়ান, আবদুস ছাত্তার মৃধা প্রমুখ অন্যতম।

 

জয়পুরহাটের লোকসাহিত্য

লোকসাহিত্য ছড়া, পল্লীগীতি, সারি, জারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, ধাঁধা, মেয়েলি গীত প্রভৃতি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত থাকলেও ছন্দ-রসের দিক দিয়ে এতটুকু সৌন্দর্যহানি ঘটেনি। জয়পুরহাটের পথে-প্রান্তরে নিরক্ষর লোকের ঘরে ঘরে গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুঘুর ডাকে, বর্ষার ঝর-ঝরানির গানে, শরতের মেঘমুক্ত উদার আকাশে, হেমন্তের শ্যামল শস্যের অপরূপ শোভায়, শীতের মিঠেল রৌদ্রকিরণে আর বসন্তের কুহুকুহু তানে লোকসাহিত্যের অসংখ্য উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।

 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছের পাকা আম লক্ষ্য করে যখন ছোট ছেলেমেয়েরা মিষ্টি সুরে ছড়া কাটে, তখন কতই না মধুর মনে হয়—

আঠালো মাটির ঘর, আম দুরাদুর পড়।

কাউয়া আমার কাকা, আম ফেলে দে পাকা।

 

আবার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে যখন আমের বীজ থেকে চারা গজায়, তখন ছেলেমেয়েরা আমবীজ শাসের ওপর কিংবা গাছের ছালে ঘষে বাঁশি তৈরি করে আর বলে—

আমকুয়া জামকুয়া তেঁতুল কুয়া আনে

কচুগাড়ি ফেলে দিলে চিনাজোঁকে টানে।

বড় বউ কাপড় ধোয় ছোট বউ নাচে

আমার বাঁশি বাজে— বাজে।

আবার বর্ষাকালে পথঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তবু তারা আকাশকে বর্ষার ঢল নিয়ে আসার মিনতি জানায়—

আয় দেওয়া ঢ’লে, কালাই দিব ম’লে

কালাই গেল উত্তরে, ঢাক বাজে ভিতরে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads