• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

শিক্ষা খাতে যুগোপযোগী নীতি গ্রহণের প্রয়োজন

  • আরাফাত শাহীন
  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট : লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার দুর্বল মানের কারণে বাংলাদেশের একজন শিশুর ১১ বছরের স্কুলজীবনের সাড়ে চার বছর নষ্ট হয়ে যায়। তারা ১১ বছরে শেখে মাত্র সাড়ে ছয় বছরের পাঠ্যক্রমের সমান। আবার দেশের পঞ্চম শ্রেণির প্রতি চারজন শিক্ষার্থীর তিনজনই নিজেদের শ্রেণির উপযোগী সাধারণ মানের অঙ্ক কষতে পারে না। এ দেশের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে বাংলা পড়ার দক্ষতা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্কোর খুবই কম। এর মানে, তারা ভালোভাবে বাংলা বলতে পারে না। তাদের ৪৩ শতাংশ বাংলায় কোনো প্রশ্নের পুরো উত্তরও দিতে পারে না। আমাদের দেশে আজ শুধু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাই বিপর্যস্ত নয়; বরং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার মান খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। প্রতি বছর পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করা হয়। আমাদের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান সেখানে হয় না। এটা জাতি হিসেবে অবশ্যই আমাদের জন্য সীমাহীন লজ্জার। স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো শিক্ষা খাতে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। সীমাহীন দুর্নীতি, প্রতিহিংসাপরায়ণ ছাত্ররাজনীতি, গবেষণা খাতে বরাদ্দ না থাকা এসব কারণে আমরা দিন দিন কেবল পিছিয়েই পড়ছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন আর গবেষণামুখী নয়। বিশ্ববিদ্যালয়েও আজ নৈতিকতার চর্চা নেই। ফলে আমরা একটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। অথচ অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থী বেকারত্বের অভিশাপ নিজের কাঁধে বহন করে চলেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়েও নিজেদের পছন্দমতো কর্মে প্রবেশ করতে পারছে না। কারণ বাইরের দেশের শিক্ষার চেয়ে আমাদের দেশের শিক্ষার মান অনেকাংশে নিম্নমুখী।

আমাদের দেশের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রতিবেদন নিশ্চয়ই সুখের কোনো বিষয় নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় যে ঘুণ ধরেছে, এটা তারই প্রকাশ। আমাদের দেশের শিক্ষা নিয়ে শুরু থেকেই খুব একটা নজর দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে, ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই চায়নি আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষায় বিশেষ অগ্রগতি লাভ করুক। কারণ শিক্ষিত মানুষকে ইচ্ছামতো শোষণ করার সুযোগ নেই- ঔপনিবেশিক শাসকরা সেটা বেশ ভালোই জানত। সুতরাং বার বার অবহেলা এবং অযত্নের শিকার হয়েছে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা। ব্রিটিশ বেনিয়ারা যে শিক্ষাব্যবস্থা আজ থেকে দুইশ বছর আগে চালু করেছিল, আজো তা আমাদের দেশে চলমান রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আরো উন্নত করে গড়ে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয়, আমরা সেটা করতে পারিনি।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে শুধু স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, শুধু স্কুলপড়ুয়া নয়, কলেজপড়ুয়া এমনকি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কেও এ কথাটি খুব একটা অন্যায্য বলে বিবেচিত হবে না। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ ইংরেজি ভাষা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। বর্তমান সময়ে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা গড়ে তোলার অপরিহার্যতা কতটুকু, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ব্যবহূত আন্তর্জাতিক এই ভাষাটি আমাদের কাছে ভীষণ ভীতিকর একটা ব্যাপার। শুধু ইংরেজি ভাষা কেন, নিজ মাতৃভাষা বাংলায় কতজন শিক্ষার্থী ঠিকমতো কথা বলতে বা শুদ্ধ করে লিখতে পারবে, সে ব্যাপারে আমি ঘোর সন্দিহান। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার কথা যখন এলো, তখন যারা এসব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন তাদের কথাও কিছুটা বলা প্রয়োজন।

আমি বেশ কিছুদিন আগে আমার এলাকার এক স্বনামধন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সুপরিচিত শিক্ষকের সঙ্গে তার স্কুলে শিক্ষার হালচাল নিয়ে কথা বলেছি। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, বর্তমান সময়ে স্কুলে যেসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা ঠিকমতো বাংলা বই পড়তে পারেন না। কথাটা শুনে প্রথমে আমি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। পরে স্যার যখন বললেন, লাখ লাখ টাকা নিয়ে এসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তখন বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও আমাদের পেছনে পেছনে চলে আসছে। আমাদের দেশের অন্য সব খাতের মতো শিক্ষা খাতও দুর্নীতির থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। বরং বর্তমান সময়ে শিক্ষা খাতই যেন সর্বোচ্চ মাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে আমাদের নৈতিকতার কোনো স্পর্শ নেই। কথাটা কতটা বাস্তবিক তা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমরা কি আসলেই শিক্ষিত হচ্ছি? আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার লেশমাত্র কি আছে?

আমাদের অভিভাবকরা এখন তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। কারণ অধিকাংশের ধারণা, স্কুলে ঠিকমতো পড়ানো হয় না। হয়তো তাদের এই চিন্তা একেবারে অমূলক নয়। কিন্তু এমন চিন্তা সংক্রামক ব্যাধির মতো ক্রমেই সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা এখন তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপনে পূর্ণ কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা যে তাদের কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত, সেটা তারা কল্পনাও করতে পারছেন না।

হয়তো স্কুলে এখন আগের মতো পড়ানো হয় না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কোচিং সেন্টার কখনো স্কুলের বিকল্প হতে পারে না। স্কুলে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু বই পড়া শেখানোই হয় না; বরং শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য স্কুল এবং এর ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের শিশুদের যদি আমরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অবশ্যই তাদের স্কুলে পাঠাতে হবে। তাই শুধু রেজাল্টের দিকে না তাকিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা এবং শিক্ষা খাতে যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমেই কেবল এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ধৎধভধঃংযধযববহৎঁ—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads