• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মানসম্মত শিক্ষার চ্যালেঞ্জসমূহ

মানসম্মত শিক্ষার চ্যালেঞ্জসমূহ

ছবি : প্রতীকী

ফিচার

মানসম্মত শিক্ষার চ্যালেঞ্জসমূহ

  • শরীফুর রহমান আদিল
  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশ দিন দিন উন্নত হচ্ছে এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার মানের দিন দিন অবনতি ঘটছে। স্বাধীনতার পর থেকে সব সেক্টরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও একমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে পড়েনি উন্নয়নের ছোঁয়া। বাজেটে কমছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। ভারকি ফাউন্ডেশনের প্রায় সব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকের মান সূচকের নিম্নমুখী। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনস অব ওয়েলবিইং ডাইমেনশনস প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮! অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশ বৈশ্বিক সূচকের দিকে এখনো পিছিয়ে। সুতরাং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জসমূহ খুঁজে বের করে তা সমাধানে রূপকল্প ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে কিংবা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে সূচকে অগ্রগামী হতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়াবলির প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সব প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ, নারী-পুরুষের সমতা ও নারীশিক্ষায় অগ্রগতি হওয়ায় পাঁচ বছর আগে যে বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কো বাংলাদেশি শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছিল, পাঁচ বছর পর সেই বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কো বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছে। অন্যদিকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা, যেমন ভারকি ফাউন্ডেশন, ফাউন্ডেশনস ওয়েলবিইং ডাইমেনশনস সহ আরো অনেকে বাংলাদেশে শিক্ষার মান ও শিক্ষকের অবস্থান নিয়ে নিম্নমুখী সূচক প্রকাশ করে। এ ছাড়া দেশ- বিদেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদরা বর্তমান শিক্ষার মান ও শিক্ষা খাতে সরকারের অমনোযোগিতার কঠোর সমালোচনা করছেন। দেশের উন্নয়নে যে রূপকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে, ঠিক তেমনি শিক্ষার উন্নয়ন ও মানসম্মত শিক্ষার বিস্তারে রূপকল্প ঘোষণা করতে হবে।

শিক্ষায় অপ্রতুল বাজেট আমাদের শিক্ষার মানকে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাজেটের আকার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সে হিসেবে শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যেমন ২০১০-১১ বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪.২ শতাংশ কিন্তু পরের বাজেটগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে হয়েছে যথাক্রমে ১২.৪, ১১.৫ ও ১১.৪ শতাংশ। ২০১৭-২০১৮ বাজেটে এ খাতে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ১২.৬ শতাংশ করলেও কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৪১ শতাংশে। শিক্ষায় মনোন্নয়ন করতে হলে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ২৩ শতাংশ বাজেট নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে তার জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ জিডিপির ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে খরচ করে।

দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এমপিওভুক্ত বলে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে না। প্রয়োজনে সরকার আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে আর না পারলে তাতে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেবে। এক কথায়, দেশে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হবে শতকরা ৭০ শতাংশ আর সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে ৩০ শতাংশ।

স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি কলেজ হয়েছে মাত্র ৭০০টি! আর এসব প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই শহরকেন্দ্রিক। ফলে গ্রাম কিংবা তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষা সেবা পাচ্ছে না দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সবার জন্য শিক্ষা স্লোগান বাস্তবায়নের পথে থাকলেও সবার জন্য সরকারি কিংবা কম খরচে শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। জনগণের দোরগোড়ায় অন্যান্য সরকারি সেবা যেভাবে মানুষ ভোগ করছে, সেভাবে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ও তাদের সন্তানদের জন্য সরকারি শিক্ষা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি ও মাধ্যমিকে একটি দ্বিতীয় শ্রেণি ৩টি প্রথম শ্রেণি করা। একই সঙ্গে এ দুটি স্তরের কোনো ক্ষেত্রেই মাস্টার্সের কম কোনো প্রার্থীকে আবেদনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সব স্তরে প্রথম শ্রেণি বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে সহকারী, সহযোগী অধ্যাপক, ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির জন্য এমফিল/পিএইচডি বাধ্যতামূলক করা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধান রাখা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে আবেদনের যোগ্যতায় অবশ্যই উচ্চতর ডিগ্রি থাকার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাবিদরা সবসময় সরকারের কাছে দাবি জানালেও এমপিও নীতিমালা ২০১৮-তে তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্তদের শিক্ষকতার জন্য আবেদন করার সুযোগ দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে সেকেলে ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বিধিতে শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণী। ২৭ বছর পর শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রথম শ্রেণি ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়; কিন্তু উল্টো তৃতীয় শ্রেণিকে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ করে দিল মন্ত্রণালয়!

এমপিওপ্রথার জন্য নন-এমপিও শিক্ষকরা আন্দোলন করলেও মূলত এমপিওপ্রথা শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বাজে ও অকার্যকর পদ্ধতি বলে মনে করি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া অসম্ভব। কেননা এখানে নেই বদলির ব্যবস্থা, রয়েছে অশিক্ষিত ও পেশিশক্তি ব্যবহারকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালনা পর্ষদ। শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখার স্বার্থে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা হয় না। অথচ উন্নত বিশ্বে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারিভাবে যেসব গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকেও সরকার সহায়তা করে। গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সরকারিভাবে বিভিন্ন পোস্ট ডক্টোরাল প্রতিষ্ঠান খোলা প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও কমিশনের কথা বলা থাকলেও এখনো তা কার্যকর করা যায়নি। শিক্ষক সুরক্ষায় কোনো আইন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের চিত্র, নারায়ণগঞ্জে এমপি কর্তৃক শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের লাশ উদ্ধারের ঘটনা থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষকতা পেশা হিসেবে এদের মান-মর্যাদা থাকার কথা অনেক উপরে এবং এদের এ বিষয়ে সুরক্ষা পাওয়ার কথা বা এ-সংক্রান্ত একটি আইন থাকার কথা কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষক সুরক্ষা আইন বলে কিছু নেই।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিনামূলে বই বিতরণ করে প্রশংসার ভাগী হয়েছে সরকার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের সময়সূচি ১০টা-৪টা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রাইভেট কিংবা স্পেশাল ক্লাস করতে হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সময় পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে নতুবা শিক্ষার্থীদের দুপুরে টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও প্রাথমিকে সীমিত আকারে টিফিনের ব্যবস্থা রয়েছে তবু তার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।     

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শিক্ষকরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও বাংলাদেশের শিক্ষকরা রাজনীতির প্রতি অতি আগ্রহী। রাজনীতি পদে থাকা, রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া-নেওয়া, রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা, পক্ষপাতিত্ব, শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি প্রভৃতি এখন দেশের অধিকাংশ শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং শিক্ষকদের গবেষণাধর্মী মানসম্মত শিখন নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের জন্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্যে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম খোরাক হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ। যত বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যাবে, তত বেশি মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে। প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতি বছর অন্তত একটি করে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি করে প্রশিক্ষণ সেন্টার বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতি চার-পাঁচ বছর পর বিদেশে প্রত্যেক শিক্ষককে পাঠিয়ে বিদেশি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারের নির্দিষ্ট পলিসি, পরিকল্পনা কিংবা এ সেক্টরে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় রাজনৈতিক পরিচয়ে, যশ-খ্যাতি কিংবা সুনামের জন্য অথবা দুর্নীতিবাজ বোর্ড কিংবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে প্রতিটি বাড়ির সামনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার মানকে একেবারে তলানিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাই তাদের এমপিও ধরে রাখতে প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষায় এমসিকিউ বলে দেওয়া ও পরীক্ষায় অনৈতিক সাহায্য করার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ি বাড়ি ছাত্র খুঁজে আনার প্রবণতা বন্ধে প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একীভূত করা দরকার। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কিংবা সমাবেশে শিক্ষক পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বৈশ্বিক যে ক্যাম্পেইন কিংবা প্রজেক্টগুলো রয়েছে, সেখানে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।

 

লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও নীতি-বিশ্লেষক

ধফরষ-লহঁ—ুধযড়ড়.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads