• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ১৭ মার্চ ২০১৯

পৃথিবীর ইতিহাসে, নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে যে ক’জন ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপনিবেশবাদ ও কায়েমি স্বার্থের শৃঙ্খল ছিন্ন করে সাধারণ মানুষের অধিকার আর মানবতা প্রতিষ্ঠায় নিঃস্বার্থপ্রাণ ছিলেন এই মহান নেতা। সমগ্র জাতিকে সুসংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু বিপর্যস্ত জাতির সামনে খুলে দিলেন এক সোনালি উষার স্বর্ণদ্বার। তার সাহসী নেতৃত্বে আমরা আজ স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করেছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪০ সালে। ছাত্ররাজনীতির ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা শেখ মুজিব ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ১৪৩টি আসন লাভ করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে এবং তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি হয় এবং ১১ অক্টোবর নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করে ১৯৬৬ সালে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন। একজন সংগঠক হিসেবে শেখ মুজিব দলের ওপর এতটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই তাকে বাঙালিদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে এক অকুতোভয় সেনানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। ’৫২-এর বাংলা ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৬৬ সালে তিনি তার বিখ্যাত ৬-দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ৬-দফাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরা হয়েছিল। ৬-দফা কর্মসূচি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের মর্মমূলে সুনির্দিষ্ট আঘাত হানতে পারায় তা অতিদ্রুত গোটা জাতির মনোযোগ আকর্ষণ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক অবস্থানে ভীতসন্ত্রস্ত আইয়ুব সরকার তাকে কারারুদ্ধ করে রাখার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব শাসনের অধিকাংশ সময়ই (১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারারুদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ও সম্মোহনী নেতৃত্ব এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ১৯৬৯ সালের প্রথম ভাগে এক প্রবল বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে এবং ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব সরকার তাকে বিনাশর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার কারামুক্তির পরের দিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে শেখ মুজিবের সম্মানে এক বিশাল নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে এবং তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তারা এক অবিসংবাদী নেতৃত্বকে খুঁজে পান, যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের মধ্যে প্রায় ১২ বছর সময়কাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মুখপাত্রের স্বীকৃতি লাভ করেন। এ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এর পরই শুরু হয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয় পটপরিবর্তন ও নেপথ্যের মহড়া। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।

১৯৭১-এর ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তার অবর্তমানে তাকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইতিহাসের সুচিহ্নিত আরেকটি দিন। এই দিন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিপান এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সরকারকে অত্যন্ত প্রতিকূল এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। তার সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসন এবং তাদের দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, জনগণের রুদ্ররোষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের জীবন রক্ষা এবং অসংখ্য অনাহারী ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন জোগানসহ আরো অনেক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে এদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ বাসভবনে কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারের হাতে সপরিবারে নিহত হন। এভাবে অবসান ঘটে একজন কীর্তিমান নেতার জীবন।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাঙালি জাতিকে সুসংগঠিত করে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে গৌরবান্বিত আসন দানের একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তার আত্মত্যাগ জাতিকে এক সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এদেশের মুক্তিসংগ্রামের পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বুকে চির অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads