• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

উৎপল দত্ত : শ্রেণিসংগ্রামের অনন্য মঞ্চনায়ক

  • মযহারুল ইসলাম বাবলা
  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০১৯

উৎপল দত্ত মূলত পূর্ব বাংলার মানুষ। জন্মেছিলেন ২৯ মার্চ ১৯২৯ সালে বরিশাল জেলায়। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। মঞ্চনাটকে তার পদার্পণ কলেজের পাঠ্যসূচির শেকসপিয়রের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে। কলেজে অভিনীত নাটকগুলো কিন্তু বাংলায় নয়, ইংরেজি ভাষায় মঞ্চস্থ হতো। শেকসপিয়র আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানির সদস্য হিসেবে অনেকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের প্রভাবশালী এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন উৎপল দত্ত। স্বাধীনতার পর যৌথ প্রযোজনায় রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’, গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এবং শক্তি সামন্তের একটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ‘অবিচারে’ অভিনয়ের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।

উৎপল দত্ত মার্কসবাদী মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। তার প্রতিটি নাটকে রাজনীতি বরাবরই প্রাসঙ্গিক। নাটকে শাসক এবং শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে সরাসরি বক্তব্য নিয়ে দর্শকদের মনোজগৎকে নাড়াতে চেয়েছেন। মঞ্চনাটকের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নাটক নিয়ে গণমানুষের কাছে ছুটে গেছেন। শ্রেণি ও ইতিহাস চেতনার ভিত্তিতে তার অসাধারণ নাটকগুলোর অন্যতম টিনের তলোয়ার, রাতের অতিথি, ছায়ানট, সূর্যশিকার, মানুষের অধিকার, টোটা, লালদুর্গ, তিতুমীর, কল্লোল, দিল্লি চলো, ক্রুশবিদ্ধ কুবা, ব্যারিকেড, একলা চলো রে, জনতার আফিম, অজেয় ভিয়েতনাম ইত্যাদি।

উৎপল দত্তের নাটকে ভারতের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতি, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রাম, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমান। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণবিপ্লবের কাহিনি তার নাটকের অন্যতম বিষয়বস্তু। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব, নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসীবিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতা, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অভিযান, ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ, ১৯৪৭-এ দেশভাগের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি— ভারতবর্ষের ইতিহাসের অধ্যায়গুলো তিনি নাটকে তুলে এনেছেন। মার্কসবাদী ছিলেন বলেই তার নাটকের বিষয়বস্তুতে বিশ্বের প্রথম শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের আগের ও পরের কাল, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশোধনবাদী ভূমিকা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

১৯৪৬-এর ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে রচিত কল্লোল নাটকে তিনি নৌ-বিদ্রোহীদের নতিস্বীকারে সম্মত হননি। কল্লোল নাটকের বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করেনি। এ বিষয়ে উৎপল দত্তের ব্যক্তিগত ভাষ্য— “৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ এক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সূচনা। এটা সেই প্রক্রিয়া যা ব্রিটিশ কংগ্রেস-মুসলিম লীগ চক্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করতে বাধ্য করল স্বতঃসিদ্ধভাবে। ইতিহাসের প্রক্রিয়াই তা-ই। এই সেই প্রক্রিয়া এবং ষড়যন্ত্র, যাতে গোটা ভারতবর্ষই প্রজ্বলিত হলো বিদ্রোহে। এই সেই প্রক্রিয়া, যার অমোঘ নিয়মে ভারতীয় বুর্জোয়ারা সশস্ত্র সংগ্রামের দুঃস্বপ্নে আজো ভীত। এই প্রক্রিয়া বৈপ্লবিক স্বপ্নের। বিপ্লবের। তাই থিয়েটারের বর্ণমালায় ‘খাইবার’ আত্মসমপর্ণ করেনি, যেমন আইজেনস্টাইনের ব্যাটেলশিপ পোটেমকিনে করেনি, যদিও ইতিহাস বলে করেছিল। পোটেমকিনের বিদ্রোহীরা মহান অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে নিজেদের উপনীত করেছিল। ইতিহাসের মানদণ্ডে পোটেমকিন নাবিকদের আত্মসমর্পণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার পুনঃসূচনা। সেই বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার এক অন্যতম উপাচার কল্লোল।’

উৎপল দত্তের ইতিহাসভিত্তিক নাটকগুলোতে ইতিহাসের নানা পর্বের ঘটনায় তখনকার রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তি, রাজনীতিকদের মুখোশ উন্মোচন করেছে। পরাভূত না হয়ে দাতার মতো ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল ইংরেজ। দেশভাগ এবং কংগ্রেস দলের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকে তিনি স্বাধীনতা বলতে ছিলেন নারাজ। বলেছেন, ‘কেবলই ক্ষমতার পালাবদল, কাঠামো বদল নয়। ভারত স্বাধীন হয়েছে বিনা রক্তপাতে, অহিংস সংগ্রামে, খদ্দর পরিধানে, চরকা কাটায়? তবে তো  ক্ষুদিরামসহ অজস্র আত্মদানকারী বীর শহীদের নাম মুছে যাবে ইতিহাস থেকে? সূর্যসেন, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, তিতুমীর এবং নৌ-বিদ্রোহ, নেতাজী সুভাষের সশস্ত্র আইএনএ বাহিনী ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামের কেউ নয়?’ ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতায় জনগণের মুক্তি অর্জিত হয়নি। এ কথা তার নাটকে বার বার এসেছে।  অসাধারণ উৎপল দত্তকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে কলকাতার নাট্যদল নান্দীকারের আমন্ত্রণে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধি হিসেবে দলের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলাম। দলের একাংশ বিমানে এবং অপর অংশ সড়কপথে। দলের বিত্তবান-তারকা এবং সাধারণ নাট্যকর্মীদের বিভাজনে বৈষম্যপূর্ণ দুই পথে কলকাতায় পৌঁছেছিল ঢাকা থিয়েটার। অভিজাত তারকারা উঠেছিল বনেদি হোটেলে এবং সাধারণ নাট্যকর্মীরা শ্যামবাজারের নান্দীকারের অতিথিশালায়। আমরা তিনজন দলের কোনো অংশের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে ছিলাম কলকাতা নিউমার্কেটের পেছনের এক হোটেলে।

নান্দীকারের নাট্যোৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিল ঢাকা থিয়েটারের নাটক কেরামত মঙ্গল। সর্বভারতীয় নাট্যদলের বিভিন্ন ভাষার নাটক উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছিল। রবীন্দ্রসদনে অনেক নাটক তখন দেখার সুযোগ হয়েছিল। আগেই জেনেছিলাম উৎসবে উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের প্রদর্শনীর সংবাদ। উৎপল দত্ত আমাদের অনেকের অনুসরণযোগ্য আদর্শিক ব্যক্তিত্ব। টিনের তলোয়ার নাটকটি ক্যাসেটে বহু আগে শুনেছি। সেই টিনের তলোয়ার নাটক মঞ্চে দেখার এক ধরনের উত্তেজনা-অনুভূতি ছিল। নাটক দেখতে গিয়ে দর্শকপূর্ণ রবীন্দ্রসদনে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসি। নাটক শুরু হয়। গভীর মনোযোগে নাটক দেখছি। উৎপল দত্তের অভিনয় কাছ থেকে দেখার অন্যরকম অনুভূতি উপলব্ধি করছিলাম। তার সংলাপে-তির্যকে দর্শকদের অট্টহাসিতে যেন ফেটে পড়ছে মিলনায়তন। অভিভূত হয়েছিলাম উৎপল দত্তের মঞ্চ কাঁপানো অনন্য অভিনয় দেখে। নাটক শেষে অতি উৎসাহী আমি ছুটে যাই গ্রিনরুমে। হায়! একি! কাকে দেখছি? একটু আগে যিনি মঞ্চ কাঁপিয়ে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে এলেন, ইনি কি সেই ব্যক্তি? পরচুলা খোলার পর টেকো মাথার বৃদ্ধ ভিন্ন এক মানুষ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাকে অতি কাছ থেকে দেখে হতাশই হয়েছিলাম। তবে এই পরিণত বয়সেও মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করা তার পক্ষেই বোধকরি সম্ভব হয়েছিল।

জনগণের মুক্তিসংগ্রামে অবিচল উৎপল দত্ত অজস্র নাটক রচনা করেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন। পিপলস্ থিয়েটার এবং ভারতীয় গণনাট্যের নানা কর্মকাণ্ডে জনগণকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল করতে জীবনের সুদীর্ঘ সময় পার করেছেন। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির করতলগত। নির্বাচনী ব্যবস্থায় বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় বার বার ঘুরেফিরে আসে। সেখানে জনগণের মুক্তির দিশা নেই। এই সত্যটি উৎপল দত্ত বার বার বলেছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে শোষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে উৎপল দত্ত আমৃত্যু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে জনগণকে সচেতন করে যুক্ত করতে চেয়েছেন শ্রেণিসংগ্রামে।

উৎপল দত্তকে কাছ থেকে দেখার এবং সরাসরি মঞ্চে তার অভিনয় দেখার সেই স্মৃতি আমাকে আজো আন্দোলিত করে। ২৯ আগস্ট ১৯৯৩ অসামান্য অভিনেতা, নাট্যকার, উৎপল দত্ত কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মরদেহে কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা আচ্ছাদিত তার একটি ছবি অনেক বছর সযত্নে রেখেছিলাম। উৎপল দত্তের জন্মমাসে এই বিরল অভিনয়প্রতিভাকে জানাই শ্রদ্ধা।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads