• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুড পেরেন্টিং

সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুড পেরেন্টিং

প্রতীকী ছবি

ফিচার

সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুড পেরেন্টিং

  • ডা. ছায়েদুল হক
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০১৯

সন্তান লালনে সর্বজনীন কোনো গাইডলাইন নেই, যা মা-বাবা যথাযথভাবে অনুসরণ করে সন্তানকে নিশ্চিন্তে গড়ে তুলতে পারেন। প্রত্যেক মা-বাবা তার সামাজিক পরিবেশ, নিজস্ব সক্ষমতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের মতো করে সন্তান লালন-পালন করে থাকেন। ফলে দেখা যায়, পেরেন্টিং অনেক বিষয় যেমন মা-বাবার চিন্তা-চেতনা ও মানসিক স্তর, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের স্তর, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল।

তাই সন্তান লালন-পালন বা পেরেন্টিংয়ের ধরনও ভিন্ন হয়ে থাকে, কখনো কর্তৃত্ববাদী, কখনো বোঝাপড়ার মতো করে আবার কখনো একদম অবহেলা-অযত্নে। তবে একটি কথা অনস্বীকার্য, সন্তান লালন কোনো সহজ বিষয় নয় এবং এটি খণ্ডকালীন কোনো কাজও নয়; বরং এটি একটি পূর্ণকালীন কাজ ও জীবনে যতটি কাজের মুখোমুখি হতে হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সন্তান লালন-পালন। সন্তান লালনে কয়েকটি বিষয় সহজেই সামনে চলে আসে। সন্তানের শারীরিক উন্নয়নে উন্নতমানের খাবার ও চিকিৎসা, পরিষ্কার জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয় থেকে তাকে নিরাপদ রাখা ইত্যাদি বিষয় সব মা-বাবাই অনুধাবন করেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন।

কিছু বিষয়- ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচার-আচরণ, দায়িত্ব সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাপারে অনেক মা-বাবাই কিছুটা উদাসীন থাকেন অথবা বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করেন না। অনেকেই সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে থাকা-খাওয়া, যাতায়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মনে করেন দায়িত্ব শেষ। এবার সন্তানের পালা। সন্তানের কাজ হলো কেবল পড়াশোনা আর ভালো রেজাল্ট করা, যাতে সমাজে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।

সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ অনেক সময় মা-বাবার ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যায়। মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সন্তান বেশিরভাগ সময় মেনে নেয়। আবার অনেকে নিজের অপছন্দের বিষয়টি মেনে নিতে না পারলেও প্রতিবাদ করার সাহস রাখে না, বিশেষ করে মা-বাবা যদি কর্তৃত্বপরায়ণ হন। এক্ষেত্রে সন্তানের ভেতর এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের ভিতটি দুর্বল করে তোলে। ছোট ছোট ঘটনায় এটি তেমন প্রকাশিত না হলেও বড় ধরনের কোনো সংঘাত দেখা দিলে বিষয়টি সামনে আসে। তখন মা-বাবা ও সন্তানের জন্য সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়।

সন্তান কোনো কারণে মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলে বা অবহেলার শিকার হলে এর বিরূপ প্রভাব তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মা-বাবা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কষ্ট অন্য যে কোনো কষ্টের চেয়ে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কটি হওয়া উচিত স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত ও শ্রদ্ধামিশ্রিত। সম্পর্কটিকে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে সবার জন্য মঙ্গলজনক।

একে অন্যের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ছোট হলেও সন্তানের প্রতি মা-বাবার শ্রদ্ধাশীল আচরণ সন্তানের ভেতর শ্রদ্ধাশীল হওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে। ফলে সন্তান ভবিষ্যতে সহজেই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কোনো অবস্থাতেই সন্তানকে ক্রমাগত উপহাস করা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, তার ছোটখাটো ভুলত্রুটিতে অস্থির হয়ে ভর্ৎসনা করা, তাকে ক্রমাগত আদেশ-নিষেধের বেড়াজালে অতিষ্ঠ করে তোলা উচিত নয়। এতে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে এক সময় হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে এবং নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটি তার ভবিষ্যতের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তা ছাড়া মারধরের মতো শাস্তি ও ভীতিকর পরিবেশ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে বিরূপ করে তোলে। ফলে মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধার সম্পর্কটিতে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়। আবার সন্তানের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তার সব অন্যায়, বাড়াবাড়ি আচরণ মেনে নেওয়াও সঠিক কাজ নয়। এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা খুবই জরুরি। সন্তান যখন একটু বড় হয়, কৈশোর পার হতে থাকে, তখন নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সে ভালোবাসে। সন্তানকে তার যোগ্যতা ও সক্ষমতার মধ্যে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।

এতে তার মধ্যে একধরনের আস্থার ভাব তৈরি হয়। তা তাকে ভবিষ্যতে কর্মজীবনে সক্ষম করে তোলে। এ সময়টিতে নিজের পছন্দ-অপছন্দ গুরুত্বসহকারে সে অগ্রাধিকার দিতে চেষ্টা করে, নিজের ক্যারিয়ার বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে শুরু করে। অনেক মা-বাবা এ বিষয়টি খেয়াল করেন না বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। সন্তান অনেক সময় মা-বাবার অগোচরে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মতো করে পরিকল্পনা করে থাকে। ফলে মা-বাবার সঙ্গে সে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়ে পড়ে। অনেক সময় সিদ্ধান্তটি তার ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর বা মা-বাবার প্রত্যাশার বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় সন্তানের প্রতি মা-বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে জবরদস্তির আশ্রয় নেন।

সন্তানের জন্য একটি সঠিক সিদ্ধান্ত কেবল বোঝাপড়ার অভাবে বা সন্তানের অমতে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফলে ভবিষ্যতে অপ্রত্যাশিত কিংবা দুঃখজনক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তবে কোনো মা-বাবাই এমনটি কামনা করেন না। একইভাবে সন্তানও কেবল পরিপক্বতার অভাব ও আবেগ সংযত করার অক্ষমতাহেতু মা-বাবার পছন্দ বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং দুঃখজনক পরিণতির দিকে জীবনকে ধাবিত করে। অবশ্য কখনো এমনটি ঘটবে, তা সে ঘুণাক্ষরেও আঁচ করে না।

সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক হতে হবে খুব আন্তরিক ও বোঝাপড়ার। তা না হলে অনেক সময় সবার অজান্তেই পরিবারে নেমে আসতে পারে সমূহ সঙ্কট। কোনো প্রচেষ্টাই তখন আর কাজে আসে না।

 

লেখক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads