আফসোসের বিষয় হচ্ছে, আজ ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের এমন লেখা লিখতে হচ্ছে। শিক্ষক শব্দটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে কী ভেসে ওঠে? একজন মানুষ, যিনি আমাদের শিক্ষা দেন, যাকে দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা আসবে। পৃথিবীতে বহু পেশার মানুষ রয়েছে, বহু কারিগর। কিন্তু একমাত্র শিক্ষকরাই এমন একজন কারিগর, যারা মানুষ তৈরি করেন। অন্য যে কোনো পেশার মানুষের চেয়ে তারা হবেন আলাদা। বিশ্বের সব পেশার মানুষ পেশাগত কাজ করতে গিয়ে অন্যায়, দুর্নীতি করতে পারেন কিন্তু শিক্ষকরা তা পারেন না। নীতি, আদর্শ, সততা, নির্লোভ- এই গুণগুলো আর কারো মাঝে থাকুক বা না থাকুক, একজন শিক্ষকের মধ্যে না থাকলে তিনি ক্লাসে যত ভালোই পড়ান না কেন, তাকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।
সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা দেখলাম বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক কী নির্লজ্জের মতো মিথ্যাচার, পক্ষপাতিত্ব ও ভোট কারচুপিতে অংশ নিলেন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ঢাবি উপাচার্যের একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি। ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান যেখানে বললেন এই নির্বাচনে আমি বিব্রত, সেখানে ঢাবি উপাচার্য কীভাবে নির্লজ্জের মতো বলেন- আমি খুব আনন্দিত অনুভব করছি, অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। তারপর আমরা দেখেছি কুয়েত মৈত্রী হলের প্রভোস্ট কীভাবে ভোট জালিয়াতি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খেয়ে অপসারিত হয়েছেন। অন্যান্য হল প্রভোস্ট এবং নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেই তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই হাজার শিক্ষক রয়েছেন, তার মধ্য থেকে মাত্র ৮ জন শিক্ষককে আমরা ডাকসু নির্বাচনের কারচুপি নিয়ে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু সব শিক্ষকের উচিত ছিল এটা নিয়ে কথা বলা। পক্ষ-বিপক্ষ কোনো বিষয় নয়, নির্বাচনে যা ঘটেছে এবং যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করা। প্রতিবাদ না করতে পারলে সবার একযোগে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। শিক্ষকরাই যদি অন্যায় দেখে চুপ করে বসে থাকেন, তাহলে ছাত্ররা কী শিখবে! যেখানে একটি পক্ষ ছাড়া সবাই কারচুপির প্রতিবাদ করছে, লিখিত অভিযোগ দিচ্ছে, প্রমাণ দেখাচ্ছে- সেখানে কীভাবে উপাচার্য, প্রক্টর মিথ্যাচার করে যান আমার বোধগম্য হয় না। শুধু এ ঘটনাগুলোই নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমরা শিক্ষক নামের কিছু কলঙ্কিত মুখ দেখতে পাই, যারা ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপাচার্যের অফিসে বসে থাকেন। এক বছর মেয়াদ পূর্ণ না হতেই পেয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বড় বড় দায়িত্ব। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পড়া না পড়িয়ে শিক্ষা দেন কীভাবে চাটুকারিতা করে উপরে উঠতে হয়। কীভাবে ডিপার্টমেন্ট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে অর্থ সরিয়ে নিজের পকেট ভরতে হয়। শিক্ষক রাজনীতির ফলাফল হিসেবে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনে আরেকজন শিক্ষককে ছোট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষকদের সম্পর্কে ধীরে ধীরে একটি বিরূপ ধারণা জন্ম নিচ্ছে, শিক্ষকদের জন্য মন থেকে সম্মান করার ব্যাপারটি উঠে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, এসব অসৎ শিক্ষকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অবশ্যই নীতি আদর্শ ধারণ করা শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। সব শিক্ষকের কাছে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে অনুরোধ, আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন যেন ভবিষ্যতে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি- আমি অমুক স্যারের ছাত্র ছিলাম।
লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
লধযরফরৎ৯৭—মসধরষ.পড়স