• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নাঈম : এক খুদে শিক্ষকের নাম

পানির পাইপ ধরে বসে থাকা নাঈম ইসলাম

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

নাঈম : এক খুদে শিক্ষকের নাম

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০১৯

লাল রঙের পানির পাইপটি নীল পলিথিন দিয়ে প্যাঁচানো। তার ওপর এক পা ও দু’হাত চেপে বসে আছে এক বালক। দৃষ্টি তার উপরের দিকে। দেখেই বোঝা যায় পানিতে তার সমস্ত শরীর ভেজা। যার কথা বলছি, তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সে এখন রীতিমতো হিরো। হ্যাঁ, গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের সময় দমকল বাহিনীর ফাটা পানির পাইপ ধরে বসে থাকা নাঈম ইসলামের কথাই বলছি। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্যাণে তার পরিচিতি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে। কোনো এক ব্যক্তি এ বালক যোদ্ধার ছবিটি ফেসবুকে দিলে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তারপর ভাইরাল হয়ে যায় সে ছবি। নজর কাড়ে অনেকেরই। তেমনি একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক ওমর ফারুক সামি। তিনি নাঈমকে পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছেন ওর লেখাপড়ার খরচের। নাঈম এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। থাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর কড়াইলের বউবাজারের বস্তিতে। তার বাবা রুহুল আমিন ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করে।  মা নাজমা বেগম গৃহিণী।

গত ২৯ মার্চ সে আবার আসে দুর্ঘটনাস্থলে। আসার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে যায় তাকে ঘিরে। সাংবাদিকরা নেন তার সাক্ষাৎকার। নাঈম জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের খবর টিভিতে দেখে সে দৌড়ে ঘটনাস্থলে চলে আসে। এসে দেখে দমকলের পাইপ ফেটে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। সে হাত দিয়ে তা চেপে ধরে। কেউ একজন একটি পলিথিন এনে দেয়। সেটা পেঁচিয়ে বসে থাকে তার ওপর। নাঈম বলেছে, আগুনে অনেক লোক মারা যেতে পারে এটা ভেবে তারা যাতে মারা না যায়, সে জন্যই সে পাইপ ধরে বসে ছিল। আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিতে পেরে সে আনন্দিত। দুই বছর আগে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের আগুন নেভানোর কাজেও সে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহযোগিতা করেছিল। নাঈমের ইচ্ছা বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হওয়ার।

শিশু নাঈমের কাজটি নিয়ে এদিক-সেদিক বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এফ আর ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তুলনায় তার এ কাজ নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হতে পারে কারো কারো কাছে। হয়তো এটাও মনে হতে পারে, ওই ছিদ্র দিয়ে আর কতটুকু পানিই বা বেরিয়ে যেত। কিংবা পলিথিন পেঁচিয়ে পা দিয়ে চেপে ধরে সে যতটুকু পানির অপচয় রোধ করেছে, তা ওই আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহূত পানির তুলনায় অতি নগণ্য। কিন্তু পরিমাণ বা আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কতখানি ছিল, তা দিয়ে নাঈমের কাজের পরিমাপ করা যাবে না। তার এ কাজের মূল্যায়ন করতে হবে অন্তর দিয়ে। এক অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ কাজ করেছে ওই শিশুটির হূদয়ে। মানুষ পুড়ে মারা যাবে— এটা তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। ওর শিশুমনকে বেদনায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। আর সে জন্যই বনানীর রাস্তায় ভিড় করা হাজারো উৎসুক মানুষের মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে সর্বগ্রাসী আগুনের তাণ্ডবলীলা দেখেনি। ওর যতটুকু শক্তি, যতটুকু সামর্থ্য তা নিয়েই দাঁড়িয়েছিল আর্তমানবতার পাশে। সে বলেছে, ওই কাজ করতে তার একটুও কষ্ট লাগেনি। তবে এতগুলো মানুষ পুড়ে মারা গেল— এটা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।

বর্তমান সময়ে নাঈম একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। আজকাল মানুষের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মানুষের প্রচণ্ড অভাব। চোখের সামনে কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে আমরা দূরে সরে যাই। ‘আবার কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি’— এ ভয়ে মানুষ হিসেবে আমাদের যে কর্তব্য, তা পালন থেকে বিরত থাকি। রাস্তায় যখন প্রকাশ্যে ছিনতাই হয়, তখন আমরা দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি। আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকার করেও কারো সাহায্য পায় না। দু-পাঁচজন দুষ্কৃতকারীর ভয়ে শত শত মানুষ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে। আমরা খবরের কাগজে প্রায়ই দেখি প্রকাশ্য দিবালোকে নারী-পুরুষ অপহরণের খবর। কিন্তু কোথাও কোনো জনতা অপহরণকারীদের প্রতিরোধ করতে সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছে— এমন খবর পাই না। এ যেন এক ধরনের দৈন্য। আমরা আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা যেন বিস্মৃত হয়েছি। কবির সে কথাও বোধকরি আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে— ‘আপনারে ল’য়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেউ অবনী ’পরে/ সকলের জন্য সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ আমরা এখন নিজেদের নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। অন্যদের দিকে তাকানোর সময় কোথায়? বলাই বাহুল্য, ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা আমাদের মগজ-মননে এমনভাবে বাসা বেঁধেছে, আমাদের হূদয়ের সুকুমারবৃত্তি, মানবিক মূল্যবোধ সব যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম কেউ বিপদে পড়লে, অসুখ-বিসুখ হলে পাড়া-প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসতেন সাহায্য করতে। গ্রামে এখনো এ পারস্পরিক সহমর্মিতার বিষয়টি আছে। তবে স্বার্থচিন্তা সেখানেও ডালপালা মেলেছে। তাই আগের মতো সৌহার্দ্য ও সৌভ্রাতৃত্ব আর  নেই। তবে এখনো সেখানে কিছুটা হলেও মানবিকতার বায়ু প্রবহমান আছে। কিন্তু শহরে তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়াই দায়। কারো দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। সবাই যেন ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। কী এক সোনার হরিণের পিছে।   

আজ শিশু নাঈমের কথা আলোচিত হচ্ছে। সবাই তার প্রশংসা করছে। এ ছেলে বড় হয়ে দেশের সম্পদ হবে, মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে, সে আমাদের গর্বের ধন, কত কী। কিন্তু আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য আমরা কতটুকু পালন করেছি বা করছি? বনানীর অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য যারা টেলিভিশনে সরাসরি দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন যে, হাজার হাজার মানুষ সেখানে কৌতূহলী দর্শকের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের এতটুকু সহযোগিতা করতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। তবে সমালোচনা করতে দেখা গেছে অনেককেই। ফায়ার সার্ভিস এটা করছে না কেন, ওটা কেন করল, এটা নেই কেন, ওটা আনছে না কেন ইত্যাদি কথা বেশ শোনা গেছে। না, এটা বলছি না ওখানে উপস্থিত সবার আগুনে ঝাঁপ দেওয়া উচিত ছিল। তবে কারো প্রচেষ্টায় যদি একজন মানুষও রক্ষা পেত, তাহলেও বুক ফুলিয়ে বলা যেত— আমরা সামান্য হলেও কিছু একটা করেছি।

শিশু নাঈম মানুষের জীবন রক্ষার জন্য ছুটে গিয়েছিল বনানীর রাস্তায়। আর আমাদেরই সমাজের উপর তলার কিছু মানুষ আরো উপরে ওঠার জন্য বানিয়ে রেখেছে মৃত্যুকূপ। রাজধানী ঢাকায় সাড়ে এগারো হাজার ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ— এ তথ্য জানার পর পিলে না চমকে উপায় আছে? কারা বানিয়েছে এসব ভবন, কারা অনুমোদন দিয়েছে নকশা, কারা দিয়েছে তা ব্যবহারের অনুমতিপত্র— তা কি কারো অজানা? এসব কাজের জন্য সরকারের ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট আছে। তারা কি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন? করেননি। কেন করেননি তা বলা নিষ্প্রয়োজন। কোন জাদুমন্ত্রের বলে নকশাবহির্ভূত বা বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা ভবন ব্যবহারের অনুমতি পায়, সে রহস্য এখন সবার জানা। যে ভবনটিকে নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, সেই এফ আর টাওয়রের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আগে থেকেই যথাযথ ছিল না। এ বিষয়টি ভবনওয়ালাদের জানানোও হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বহু আগে ভবনটি পরিদর্শন করে একাধিকবার ভবন কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল জুলফিকার রহমান বাংলাদেশের খবরকে জানিয়েছেন, ভবনটি পর্যবেক্ষণ করে ইতোপূর্বে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ভবন কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। অপ্রতুল ও ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভবনের ফায়ার সেফটি বিষয়ে মালিকপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে এটা এখন পরিষ্কার যে, এফ আর টাওয়ারে ভয়ঙ্কর আগুন দুর্ঘটনা ভবনটির নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান তথা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অপরিণামদর্শী কাজের ফলশ্রুতি। পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। তার এ মন্তব্য যথার্থ। কেননা ভবন কর্তৃপক্ষ জেনেশুনেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে যে প্রশ্নটি এখানে বড় হয়ে দেখা দেয় তা হলো— শুধু নোটিশ দিয়েই কী ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারে? নোটিশ গ্রহীতা যদি তা আমলে না নেয়, রাষ্ট্রের আইন প্রতিপালনে অনীহা দেখায় বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানও তো আছে। তা হলে সরকারি নির্দেশ অমান্য করার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে— এ কথা কি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিতে পারে? তেমনিভাবে রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দফতরও এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির দায় এড়াতে পারবে না।

এটা এখন পরিষ্কার যে, ভবনটির জমির মালিক এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সরকারি বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে যেমন অপরাধ করেছে, তেমনি রাজউক, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও তাদের দায়িত্ব পালন না করে অপরাধ করেছে। এখন দেখার বিষয় সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়। একটি কথা সচেতন ব্যক্তিরা বলে থাকেন, আমরা যদি স্ব স্ব দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করতাম, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই এড়ানো সম্ভব হতো। 

নাঈম আজ হিরো। তার কর্তব্যবোধ তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। একই সঙ্গে নড়িয়ে দিয়েছে আমাদের টনক, স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কর্তব্যবোধের কথা। শুধু তা-ই নয়, সে আমাদের এ শিক্ষাও দিয়েছে যে, কথা নয়- কাজই মানুষকে বড় করে, বিখ্যাত করে। প্রশ্ন হলো, এই খুদে শিক্ষকের দেওয়া শিক্ষা কী আমাদের বিবেককে জাগ্রত করবে?

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads