বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সবচেয়ে বেশি প্রচার করে যে রাষ্ট্রটি, সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা নিজেদের মানবতার অতন্দ্র প্রহরী মনে করে। ব্রিটিশরা একসময় যে কাজটি করার দায়ভার হাতে নিয়েছিল, আজকের যুগে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ঠিক সেই কাজটিই করে দেখাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত কোনো দেশে যদি অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সৃষ্টি হয়, তাহলে ‘গণতন্ত্র রক্ষার অজুহাত’ দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেবে। বিশ্বের ১৩০টিরও অধিক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আছে। মানবতা রক্ষার নামে তারা সে সব দেশে কী করছে, সেটা ভুক্তভোগীরাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে ইউরোপের দেশগুলোও কম সোচ্চার নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মানবতার সেবা কতটুকু করছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সুইডিশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বর্তমান বিশ্বে অস্ত্র রফতানির শীর্ষ তালিকায় যে পাঁচটি দেশের নাম উল্লেখ করেছে, সেগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন। পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবার উপরে। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে বিশ্বের বৃহৎ পাঁচ শক্তি গত পাঁচ বছরে মোট অস্ত্রের ৭৫ শতাংশের জোগান দিয়েছে, এসব অস্ত্রের ক্রেতা কারা? গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালে অস্ত্র আমদানি করা শীর্ষ পাঁচটি দেশ সৌদি আরব, ভারত, মিসর, অস্ট্রেলিয়া ও আলজেরিয়া।
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন তার দেশে রাসায়নিক অস্ত্র মজুত করেছেন- এই অজুহাতেই তো মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি ইরাক আক্রমণ করে! লাখ লাখ নিরীহ ইরাকি জনগণ তাদের জীবন দিয়ে দিল। তাহলে যারা সবসময় প্রচার করে অস্ত্র ভয়ঙ্কর জিনিস, কোনো দেশে অস্ত্র মজুত করা যাবে না- তারাই কেন অস্ত্র বিক্রির তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে? প্রশ্ন তো এটাই। আর এখানেই সবচেয়ে বড় রাজনীতি। কোনো দেশ যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে সবসময় সোচ্চার। অথচ তারা প্রতিনিয়ত পারমাণবিক শক্তিতে নিজেদের বলীয়ান করে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, তারা কি সত্যি সত্যিই পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?
যে অস্ত্রগুলো কিনে আনা হচ্ছে, সেসব অস্ত্র প্রতিটি দেশের নিরীহ মানুষের ওপর ব্যবহার করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করা সৌদি আরব তাদের অস্ত্র ব্যবহার করছে ইয়েমেনে। বহুদিন হলো সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। সেখানে প্রতিনিয়ত বোমা পড়ছে এবং নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে। ইয়েমেনে এখন মানবিক বিপর্যয় চরমে। দেশটিতে এখন চলছে স্মরণকালের সবচেয়ে কঠিন দুর্যোগ। এসব দেখেও মানবতার ধ্বজাধারীরা চুপচাপ বসে আছে। শুধু ইয়েমেন নয়, সমগ্র আরবেই অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে মিসরও কম যায় না। বহুদিনের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে মিসরীয়রা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। অথচ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তখন থেকে মিসরের সাধারণ জনতার ওপর চলছে নির্মম নিষ্পেষণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্রের জোগান মিসরকে দিচ্ছে, তা দিয়েই মিসরীয় সেনাবাহিনী তাদের স্টিমরোলার চালানো অব্যাহত রাখতে পেরেছে।
ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া সর্বত্রই যেন বিরাজ করছে অশান্তির আগুন। অথচ এখানেই একসময় শান্তির বাতাস বয়ে যেত পূর্ব থেকে পশ্চিমে। যখন থেকে পশ্চিমা শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর তাদের শকুনি দৃষ্টি ফেলেছে, তখন থেকেই এখানকার শান্তি পালিয়ে গেছে চিরতরে। যে তেলসম্পদ হতে পারত মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য শান্তি এবং সমৃদ্ধির কারণ, এখন সেটাই তাদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ঙ্কর এক বিষফোঁড়া। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বুকে ঘটে যায় এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। পুরো বিশ্ব সেদিন শোকে-দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা চালায় উগ্রবাদী আল-কায়দা সংগঠনের কিছু সদস্য। বিশ্বব্যাপী মহা শোরগোল পড়ে যায়। সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেদিন থেকেই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনের পর দিন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেন বেড়েই চলেছে। আফগানিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর মার্কিন বাহিনী বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসছে নির্মম নির্যাতন। কবে এর অবসান হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না।
বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর অন্যতম পরাশক্তি হলো চীন। বিগত বছরগুলোতে তারা সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। এই মুহূর্তে কোনো দেশ যদি মার্কিনিদের চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়, তাহলে সেই দেশ হলো চীন। এই চীনও মানবতা লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। বিশ্বে যেসব জাতি নির্মম নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার, তাদের মধ্যে চীনের উইঘুর মুসলিমরা অন্যতম। প্রায় দশ লাখ উইঘুর মুসলিমকে চীন সরকার বিনা কারণে আটকে রেখেছে বন্দিশিবিরে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হলেও চীনা সরকার এটা অস্বীকার করেছে। এমনিতেই চীনে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে না।
বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটা নিয়ে সোচ্চার হলেও চীনের তাতে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের যে দেশগুলো সবসময় মুখে মানবতা এবং মানবাধিকারের কথা বলে থাকে, কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাদের দ্বারাই মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ইসরাইল বর্তমানে বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। তবে আমরা আশাবাদী, বৃহৎ শক্তিগুলো যত দ্রুত নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে শান্তির পথে অগ্রসর হবে, বিশ্বে ততই দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
smshaheen97@gmail.com