• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
নববর্ষ ও অসাম্প্রদায়িকতা

নববর্ষ ও অসাম্প্রদায়িকতা

প্রতীকী ছবি

ফিচার

নববর্ষ ও অসাম্প্রদায়িকতা

  • আশরাফুল অর্ণব বাবু
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০১৯

বাংলা বর্ষবরণ বাঙালির ঐতিহ্য। এই বর্ষবরণ মানে হিন্দুদের পুজোর আদলে একটি নতুন বছরের বরণ নয়, বরং বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি উৎসব পালন। এখানে হিন্দুয়ানি বিষয়াদি আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটির সঙ্গে মিশে আছে একজন হিন্দুর রক্ত, একজন অত্যাচারী হিন্দুরাজা ব্রাহ্মণ কিংবা নিরীহ গোবেচারার গল্প। এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে লাখো লাখো পবিত্র হিন্দু সন্ন্যাসীর ত্যাগ-তিতিক্ষা, গেঁথে আছে কোটি কোটি হিন্দু বাবার (পিতা) ঘাম, মায়ের মমতা। হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশে হিন্দুরা রাজত্ব করেছে, আমাদের শাসন করেছে, শোষণ করেছে, আবার ভালোও বেসেছে। আমরা তাদের অন্যায় কখনো মুখ বুজে সহ্য করেছি, আবার কখনো প্রতিবাদে বিদ্রোহে স্লোগান দিয়েছি, মিছিল করেছি, মরেছি ও মেরেছি। আবার কখনো এভাবে বাঙালি সত্তার সঙ্গে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এ কথা স্বীকার করতে মোটেও দ্বিধা করা উচিত নয়, বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনেকাংশেই হিন্দুধর্ম থেকে ধার করা।

অপরপক্ষে একদল লোক দাবি করে (যদিও মাত্র কয়েক শতকের ইতিহাস) বাংলাদেশে শতকরা নব্বইভাগ মুসলমান বাস করেন, এবং তারা এক ধরনের জোর গলায়ই বলতে চান, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মার মতো মিশে থাকা হিন্দুয়ানি বিষয়গুলো আলাদা করতে হবে এবং আলাদাই নয় কেবল, তা নিষিদ্ধও করতে হবে। তাদের এই আন্দোলনের একটি অন্যতম ইস্যু বর্ষবরণ তথা বাঙালির পহেলা বৈশাখ। নানান অজুহাত, নানান যুক্তি, হরেক রকমের আবেগ আর ইত্যকার টাইপের তর্কাতর্কির মাধ্যমে শুধু পহেলা বৈশাখই নয়, বাঙালির সমস্ত বিশেষ দিনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে সদা তৎপর। সুতরাং আমাদের এই চেতনা লালন করা উচিত, বাংলাদেশ হিন্দু না মুসলমানের— এর থেকেও বড় সত্য হচ্ছে, এই দেশটা বাঙালির। এ ব্যাপারে কোনো আপস নেই।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস। এই বঙ্গীয় সন পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। সম্রাট আকবর তার কর আদায়ের সুবিধার্থে তৎকালীন কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সৌরসনের প্রবর্তন করেন, কালক্রমে এটি বঙ্গাব্দ নামেই বেশি সমাদৃত হয়। এসব জানা কথা। এখানে কারোর কোনো বিভেদ নেই। এখন কথা হচ্ছে এই উৎসবের সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা পান্তা-ইলিশ যুক্ত হলো কবে? এখানেই আপত্তি তোলা হচ্ছে। শোভাযাত্রায় যেসব পুতুল ঘোড়া মুখোশ ইত্যাদি ব্যবহূত হয়, তা স্পষ্টত হিন্দুদের রীতি-নীতি বলে কিছু ধর্মান্ধ বিরোধিতা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সরলমনা বাঙালিদের ভুল পথে চালিত করার পাঁয়তারা করছে। আমাদের সেই যাত্রার ইতিহাস জানতে হবে।

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তার সমস্ত লেখা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল তৎকালীন সরকার। রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ তথা বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে রমনার পাকুড়মূলে (বটমূলে) রবীন্দ্রসঙ্গীত আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিনটি বিশেষভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ছায়ানট। পরে ক্রমেই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধেও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় শুরু হয় বাংলা নববর্ষের। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সংস্কৃতি অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং এই দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে নাগরিকদের বিশেষ করে ছাত্রদের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়, এর প্রতিবাদে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা পরিষদের আয়োজনে বর্ণাঢ্য ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনসহ বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ এবং বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে একটি বিপ্লবী শোভাযাত্রা বের হয়, এটিই কালক্রমে পরিচিতি পায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে। তাছাড়া এর উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা থেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই বাঙালির বর্ষবরণ উদযাপিত হয়ে থাকে।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads