• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
জীববৈচিত্র্য ও আমাদের ভাবনা

জীববৈচিত্র্য ও আমাদের ভাবনা

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

জীববৈচিত্র্য ও আমাদের ভাবনা

  • আলম শাইন
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০১৯

জীববৈচিত্র্য শব্দের মূল অর্থ অনেকেরই অজানা। আবার জানেন এমন মানুষটিকেও যদি ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়, তিনি বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারবেন না। যদি বোঝাতে সক্ষমও হন, সেক্ষেত্রে তিনি গোঁজামিলের আশ্রয় নেবেন। অর্থাৎ বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝাতে পারবেন না। অথচ তিনি বোঝেন শব্দটার অর্থ। বোঝাতে গিয়েই যত বিপত্তিতে পড়েন। ফলে শব্দটার মধ্যে ভিন্ন কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা জীববৈচিত্র্য বলতে পাখ-পাখালি কিংবা বন্যপ্রাণীদের সার্কেলকে বোঝানো হচ্ছে। আসলে তা নয়। শব্দটার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে প্রাণের বৈচিত্র্য। খুব সহজ অর্থ। তার পরেও মাথায় নিতে পারেন না অনেকেই। সেই কৌতূহল নিভৃত করতে এ লেখার প্রয়াস। যদি লেখাটি পাঠক হূদয়াঙ্গম করতে পারেন বোধকরি সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।

আমরা জানি, সমগ্র প্রাণিকুলকে বেঁচে থাকতে হলে একটা সার্কেলের প্রয়োজন। আর সেই সার্কেলটিই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আরো সহজে বলতে গেলে ‘পরজীবী’ শব্দটা ব্যবহার করা যায়; যদিও এক্ষেত্রে পরজীবী মানানসই নয়। ফলে আরো পরিষ্কার করে বলতে হচ্ছে বিষয়টি। অর্থাৎ এক প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলে অন্য প্রজাতির ওপর নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের মূল বিষয়। এ সার্কেলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষ। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন খাদ্য এবং ওষুধের, যা আহরিত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য থেকেই। যেমন— সহজ উদাহরণটি হচ্ছে; মানুষ খায় হাঁস, হাঁস খায় মাছ, মাছ কেঁচো খায়... ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ রিসাইকেল বলতে যা বোঝায় সেটিই জীববৈচিত্র্য। সুতরাং আমরা বলতে পারি, শুধু আমাদের দেশের জন্যই জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব আধিক্য নয়; সমগ্র বিশ্বেই রয়েছে এই জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা। জীববৈচিত্র্য নিয়ে জানলে যেমনি একজন মানুষ সচেতন হবেন, তেমনি অন্যকেও বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হবেন। তাতে করে মানুষ জীববৈচিত্র্য নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাববেন এবং সতর্ক হতে পারবেন; অন্যকেও সতর্ক করতে সক্ষম হবেন।

মূল প্রসঙ্গে ফিরছি আবার। আমরা জানি বিশ্বে বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি কর্কটক্রান্তি এবং মকরক্রান্তির মাঝামাঝি এলাকা মেগাডাইভারস হিসাবে বিবেচিত। এখানেই সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আর তেমনি একটি অঞ্চলেই আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান। সেই হিসেবে আমরা অনেকটাই সৌভাগ্যবান বলতে পারেন। কিন্তু আমরা বিষয়টির মর্ম উপলব্ধি করতে পারিনি আজ অব্দি। অহেতুক জীবের বিনাশ ঘটাচ্ছি। কারণে-অকারণেই এই কাজটি করছি আমরা। যে পোকা বা পতঙ্গটি মারার দরকার নেই; অথচ ওকে পিষে মারছি জুতার নিচে ফেলেই। আবার পুড়িয়েও মারছি। আগাছা দমনের অজুহাতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে জীববৈচিত্র্যে আঘাত হানছি। এটি বেশি করা হচ্ছে পার্বত্য এলাকায়। জুমচাষিরা পাহাড়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে আগাছা বিনাশের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস করছে। এটি অনেক সময় কিন্তু অনিচ্ছাকৃত করা হলেও, মনের অজান্তেই এসে যাচ্ছে।

যারা করছেন তারা বিষয়টি জানেন না যে, কত বড় ধরনের অপরাধ তিনি করছেন। সত্যি বলতে এ ধরনের বদঅভ্যাস আমাদের একদিনে তৈরি হয়নি। জন্মের পর অর্থাৎ জ্ঞান হওয়া অবধি থেকে আমরা এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়েছি। দেখতে বিশ্রী একটা পোকাকে মেরে ফেলতেই হবে আমাদের; অমন মানসিকতা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছে। বাবা-মা মেরেছেন আমাকেও মারতে হবে, না হলে পোকাটি ক্ষতি করতে পারে। এমন ধারণা থেকেই এ মানসিকতার জন্ম হয়েছে। অকারণে বন্যপ্রাণী নিধন, পাখির মাংস খাওয়া কিংবা পোকামাকড় পিষে মারা বা পুড়িয়ে মারা— এসব আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি; করছিও তাই। যা আমরা এখন চট করে পরিহার করতে পারছি না। ফলে জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে তুচ্ছ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির সঙ্গে যে আমাদের বেঁচে থাকার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা আমাদের অজানার কারণে এতসব সর্বনাশ করছি আমরা।

আমাদের সমগ্র দেশই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের জীববৈচিত্র্য। ছোট্ট একটি দেশ অথচ কত ধরনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি আমাদের দেশে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীববৈচিত্র্যে ঠাসা। প্রথমে আমরা সুন্দরবনের হিসাব-নিকাশে যাচ্ছি। দুই বাংলাব্যাপী সুন্দরবনের বিস্তৃতি হলেও বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের আয়তন ৩৯৮৩ বর্গ কিলোমিটার। মোট দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের অরণ্যটি ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে জীববৈচিত্র্যের কারণে। অনেকের ধারণা, সুন্দরবন বিশ্বের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে সর্ববৃহৎ বিধায় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজে স্থান পেয়েছে। আসলে তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এখানে জীববৈচিত্র্যের বিষয়টিকে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বনটি যে আকারে বৃহৎ সেটিও জরিপে এসেছে। দুয়ে মিলেই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজে স্থান পেতে সাহায্য করেছে।

যা হোক, আমরা জানি সুন্দরবন একটি শ্বাপদসংকুল অরণ্য। এই অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। যার প্রধান কারণই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য!

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই সুন্দরবনেই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৪০ ভাগের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিস্ময়কর তথ্য বটে! তার মধ্যে রয়েছে ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫০ প্রজাতির মাছ ছাড়াও রয়েছে হাঙর, কুমির, ডলফিন ও বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আর বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদের কথা আমরা বাদই দিলাম। সূত্রমতে জানা যায়, সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তার মধ্যে ৮৭টি একবীজপত্রী, ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী, ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল। যার প্রতিটি উদ্ভিদই জীববৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণের ভূমিকা রাখছে। তৎসঙ্গে টিকিয়ে রাখছে সুন্দরবনকে হাজার বছর ধরে।

সুন্দরবনের পরেই রয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। জীববৈচিত্র্যে ঠাসা সেন্টমার্টিন দ্বীপেও। মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটার পরিধির একটা দ্বীপ। অথচ দ্বীপটি যেন জীববৈচিত্র্যের স্বর্গরাজ্য। এক সমীক্ষায় জানা যায়, এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৫ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০০ প্রজাতির পাখি (দেশি ও পরিযায়ী মিলিয়ে), ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৫ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। রয়েছে পাথুরে শিলা ও হরেকরকম শৈবালের রাজ্য। এ ছাড়া অসংখ্য নারিকেল গাছ এবং কেয়াবনসহ নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। যার কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বলা হয়েছে বিশ্বের দুর্লভতম স্থানের একটি। বিশেষ করে স্বল্প আয়তনের আর কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য ও বহুল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। এখানে আরেকটি কথা বলতে হচ্ছে, বিশ্বের অতি দুর্লভতম একটি কাছিমের নাম অলিভ টার্টল। যেটি সেন্টমার্টিনে দেখা যায়। সেন্টমার্টিনে এসে ওরা ডিম পাড়ে। যদিও ডিম পাড়তে এসে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয় ওদেরকে।

সব মিলিয়ে আমরা গর্বিত এত আধিক্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বসবাস করতে পেরে। যদিও এর সারমর্ম বুঝতে সক্ষম নন অনেকেই। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা কীটপতঙ্গ দেখলেই পিষে ফেলা উচিত। আসলে যে পোকাটি আমাদের বেঁচে থাকতে নানাভাবে সাহায্য করছে তা কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি না মোটেই। সেটি আমাদের বোঝাতে হবে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। কেবল বিশেষ দিবসে এর গুরুত্ব তুলে ধরলে চলবে না, সবসময়ই কমবেশি জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিতে হবে তা হলেই রক্ষা পাবে আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিশাল ভান্ডারটি। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই এই বিশাল ভান্ডারটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হাজার বছর।

 

লেখক : বন্যপ্রাণী বিশারদ

ধষধসংযরহব—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads