• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

একুশ বছর আগে ও পরে

  • মাসুদ কামাল হিন্দোল
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশকিছু আলোচিত সংখ্যা রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ৩০ মে, ১৫ আগস্ট, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাড়াও একুশ সংখ্যাটি আলোচিত হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। একুশ বছর হিসেবে। ১৯৯৬ সালে একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা একযোগে এক সুরে বলতে থাকে ২১ বছরে সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো দেশের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। এ কথার সঙ্গে সুর মেলায় কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মিডিয়ার একাংশ। গত একুশ বছর ধরে তারা এ অভিযোগের ভাঙা রেকর্ডই বাজিয়েছেন।

একুশ বছর আগে একুশ বছরের যে অভিযোগ তারা করেছেন, তারপর পেরিয়ে গেছে আরো একুশটি বছর। আর এ একুশ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই ক্ষমতায় আছে অভিযোগকারী দল বা সরকার। যে একুশ বছরকে আওয়ামী লীগ প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে, সে সময়ের সাফল্য কিন্তু কম নয়। সে সময় আমাদের অনেক কিছুর ভিত রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, খেলা বা শিক্ষার সাফল্যের কথা বলতে গেলে সে সময়ের কথা বলতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অভিযোগগুলো ছিল রাজনৈতিক। ইতিহাসের নির্মোহ বিচারে সেই একুশ বছরের সাফল্যের কথাও উঠে আসবে আগামী দিনে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

১৯৭১-এর পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ধারা আসে। সমৃদ্ধ হতে থাকে চলচ্চিত্র। বেদের মেয়ে জোছনার মতো ব্যবসাসফল ছবি আশির দশকে হয়েছিল। নায়ক সালমান শাহর আবির্ভাবও ঘটেছে নব্বইয়ের দশকে। একুশ বছর পরও সালমান শাহকে নিয়ে আলোচনা হয়। চলচ্চিত্রে সব অসাধারণ গান রচিত হয়েছে, যে গানগুলো আজো মানুষের মুখে মুখে। আশির দশকে নতুন মুখের সন্ধানে নেমে নতুন শিল্পী খুঁজে বের করা হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন। ভালো কোনো চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে অভিযুক্ত ২১ বছরের সাফল্যের কথাই বলতে হয় ঘুরেফিরে। শ্রোতা-দর্শকরাও সেই দিনগুলোর কথাই উল্লেখ করেন।

স্বাধীনতার পর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন মঞ্চনাটক। মঞ্চনাটক সমাজ পরিবর্তন আন্দোলনের একটি অংশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। একাধিক নাট্যদল গড়ে ওঠে বিশেষ করে আশির দশকে জনপ্রিয়তা পায়। নাট্যআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে  দেশব্যাপী। গ্রাম থিয়েটারেরও প্রসার ঘটে সারা দেশে। একাধিক দেশি-বিদেশি অনুবাদ নাটক মঞ্চায়ন হতে থাকে সাফল্যের সঙ্গে। জমে ওঠে নাটক পাড়া। অসাধারণ সব কাজ তারা দর্শকদের উপহার দেন। পথনাটকও জনপ্রিয়তা পায়। সে সময়টা ছিল থিয়েটারের স্বর্ণযুগ। সে সময়ের মতো তেমন একটা কাজ হয় না বলেই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো নাটকগুলো নতুন করে পরিবেশন করার প্রবণতা বাড়ছে।

টিভি অনুষ্ঠানের কথা বলতে গেলে এখনো বাংলাদেশ টেলিভিশনের আশি-নব্বই দশকের কথাই চলে আসে। তখন বিটিভির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। বর্তমানে ৩০-৩৫টি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল হলেও ভালো কাজের উদাহরণ দিতে গেলে বিটিভিকেই টেনে আনতে হয়। বিটিভির দেশি-বিদেশি অনুষ্ঠান ছিল তুলনাহীন। সে সময়ই বিটিভি শুরু করে রিয়েলিটি শো নতুন কুঁড়ি। নিয়মিত টিভি গাইড প্রকাশিত হতো। টিভি গাইডের গ্রাহকও ছিল উল্লেখ করার মতো। পত্রিকায় টিভি সমালোচনা ছাপা হতো। টিভি সমালোচনা লিখেও কেউ কেউ আলোচিত হয়েছেন। ভারতের কলকাতার দর্শকরা ব্যাকুল হয়ে থাকতেন বিটিভির অনুষ্ঠান দেখার জন্য। তারা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের। আর আজ তাদের প্রোগ্রাম ছাড়া যেন আমরা অচল।

সে সময় টিভির পাশাপাশি রেডিও জনপ্রিয় ছিল। রেডিওর অনুষ্ঠান শোনার জন্য শ্রোতারা মুখিয়ে থাকত। রেডিওর নাটক ও নাটিকা ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়। এছাড়াও সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার, কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান, ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান, তরুণ-তরুণীদের জন্য ওয়ার্ল্ড মিউজিক, দর্পণ, মুখোমুখি, অনুরোধের আসর, খেলার ধারাভাষ্য, শিক্ষার আসর বা জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠানগুলোর কথা শ্রোতারা এখনো ভুলতে পারেনি, এমনকি আজকের এফএম রেডিওর যুগেও।

বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের বিকাশ ঘটে আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে। যদিও ব্যান্ড মিউজিক শুরু হয়েছিল আরো আগে। সে সময় ব্যান্ড মিউজিক হাটে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় নতুন এক জোয়ার। ব্যান্ড মিউজিক তারুণ্যের ধ্যান-ধারণাকেই পাল্টে দেয়। বিদেশি গানের আধিপত্যকে ম্লান করে দেয় ব্যান্ড মিউজিক। বিশেষ করে ভারতীয় বাংলা গানকে। লাখ লাখ কপি ব্যান্ডের ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে সেই দিনগুলোতে। সে সময়টাকে ক্যাসেট যুগ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ইউটিউবে দেখা যায় কমেন্ট বক্সে সেই দিনগুলোর জন্য হাহাকার।

আমাদের সংস্কৃতির আরেক অঙ্গ কবিতা আবৃতি বা বাচিক শিল্প। আশি ও নব্বই দশকের শুরুতে কবিতা আবৃত্তি অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। বের হতে থাকে কবিতার ক্যাসেট। গড়ে ওঠে নতুন নতুন কবিতার সংগঠন। টিএসসি মুখরিত হয়ে উঠত কবিতার ছন্দে। কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদও হয়েছিল। কবিতা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সেই দিনগুলোতে। বেজে উঠেছিল দরাজ কণ্ঠে হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতা- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

আশি ও নব্বই দশকে ঢাকার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় একাধিক মাঠ ছিল। সেখানে নিয়মিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। খেলাঘরের কার্যক্রমও ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাড়া-মহল্লার মাঠ দখল শুরু হয়। মাঠের সংখ্যা কমতে থাকে, যা এখন তলানিতে ঠেকেছে। তখন সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশে পাড়া-মহল্লার মাঠের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ঢাকা আজ মাঠহারা সংস্কৃতি ছাড়া। মাঠের অভাব হলে সমাজের কী অবক্ষয় ঘটে তা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

ফুটবলের দর্শক এখন ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে গেছে। অথচ আশির দশক ছিল ফুটবলের সোনালি দিন। আবাহনী-মোহামেডান খেলা হলে সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যেত দর্শকে। বাড়ির ছাদে উড়ত দুই দলের পতাকা। নব্বই দশকের শুরুতেও খেলা জমজমাট ছিল। খেলোয়াড়রা মোটা অঙ্কের সম্মানী পেতেন। ছিল তাদের তারকাখ্যাতি। ঢাকা লিগে খেলত নামিদামি সব বিদেশি ফুটবল খেলোয়াড়। বিশ্বকাপ দলে ছিলেন এমন কয়েকজন প্লেয়ারও ছিলেন। আবাহনী-মোহামেডানের অনুশীলন দেখতে যেত হাজার হাজার দর্শক। আর এখন স্টেডিয়ামের গেট খুলে দিলেও খেলায় দর্শক হয় না।

শিক্ষার কথা বলতে গেলে এখনো বলি, সে সময় শিক্ষার অবস্থা এত খারাপ ছিল না। নকল হলেও প্রশ্ন ফাঁস হতো না ক্লাস ওয়ান থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত। সুপারসনিক গতির পাসের হার ছিল না। ইংরেজির অবস্থা এতটা শোচনীয় মনে হতো না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহের। শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত না হলেও আজকের মতো ভঙ্গুর অবস্থানে ছিল না। সিলেবাসের বাইরেও পড়াশোনা করত শিক্ষার্থীরা। আজকের মতো শিক্ষা বাণিজ্য হয়ে ওঠেনি। আজ শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে সীমাহীন হতাশা।

একুশ বছরে সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো সব ধ্বংস করেছে- তাদের এ অভিযোগ ধোপে টেকে না। এসব কাজের সফলতার কথা বলতে গেলে সেই একুশ বছর আগের কথাই বলতে হয় আজো। ঢালাও অভিযোগ করতে গেলে অতীত সাফল্যকেই অস্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মী ছাড়া যেসব শিল্পী এসব অভিযোগের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন, তাদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো কিন্তু সে সময়েরই অর্জন। সেই দিনগুলোতে প্রগতিশীল সংস্কৃতির চর্চা ছিল। আজ তার অভাববোধ করছি। রাজনৈতিক হীনস্বার্থে আমরা অনেকে এখন সে সময়কালকে অস্বীকার করছি।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রম্যলেখক

hindol_khan@yahoo.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads