• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

গণমাধ্যম যেন অপরাধ উসকে না দেয়

  • রনি রেজা
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৯

সাংবাদিকদের বলা হয় সমাজের দর্পণ। অর্থাৎ সমাজের যা কিছু ভালো-মন্দ তা স্বচ্ছতার সঙ্গে তুলে ধরাই হচ্ছে সাংবাদিকদের তথা গণমাধ্যমের কাজ। স্বচ্ছতা এখানে বাহুল্য শব্দ। কেননা ভালোকে ভালো বললে আর মন্দকে মন্দ বলে উপস্থাপন করলেই স্বচ্ছতা হয়ে যায়। আলাদা করে স্বচ্ছতা শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। তবু আমি সতর্কভাবেই এই স্বচ্ছতা শব্দটি ব্যবহার করলাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবহারটাও জরুরি। যেহেতু আজ এ মহান পেশার সঙ্গে লেপ্টে গেছে দুটি নেতিবাচক শব্দ— হলুদ সাংবাদিকতা ও অপসাংবাদিকতা। আর এর প্রভাবে সমাজে কিছু অপরাধের ভাইরাসও ছড়াচ্ছে। কীভাবে ছড়াচ্ছে এটা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে আসলে গণমাধ্যমের কাজ কী? সাধারণত আমরা জানি, গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ চলৎশক্তি হিসেবে আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পরেই রয়েছে গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের অবস্থান। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকদের রাষ্ট্রপরিচালনায় কোনো প্রকার ভুল কিংবা ভ্রান্তনীতি পরিলক্ষিত হলে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া এবং প্রকারান্তরে সংশোধনের উপায়ও বাতলে দেওয়া গণমাধ্যমের কাজ।

রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে কিংবা সরকারের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ সংঘটিত হওয়ার প্রাক্কালে সঙ্গে সঙ্গে সেটি জনসম্মুখে তুলে ধরে গণপ্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সুযোগ করে দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনে সবসময়ই নিহিত থাকে গণমাধ্যম। এভাবে গণমানুষের তথ্য জানার অধিকার পূরণেও গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ শুধু সংবাদ পরিবেশন করলেই সাংবাদিকতার দায় শেষ হয়ে যায় না। গণমাধ্যমের থাকতে হবে সতত জবাবদিহিতা। স্বচ্ছ সম্পাদকীয় নীতি, ইতিবাচক, গণমুখী ও দায়িত্বশীল কর্মযজ্ঞ থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ক’টি গণমাধ্যম এসব মেনে চলে এমন প্রশ্নে বেশিরভাগই নেতিবাচক উত্তর মিলবে। এই নেতিবাচকতা নিয়েই মন্দ কাজের ভাইরাস ছড়াচ্ছে কিছু গণমাধ্যম। কোনটা প্রকাশ করা ঠিক আর কোনটা ঠিক না— সে বিষয়ে উদাসীন রয়েছে অনেক গণমাধ্যম। আর এতে যে অনেক সময় অপরাধকে উসকে দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে খেয়ালই করছে না। একবার ভেবে দেখেছি কি, দেশের কোথাও একটি অপরাধ সংঘটিত হলে কেন এর ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়? বর্তমান সময়ে মহামারী আকার ধারণ করেছে ধর্ষণ। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে।

গত শনিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘ধর্ষণের নজিরবিহীন রেকর্ড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ১০০ দিনে ৩৯৬ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চিন্তা করুন, কত দ্রুত এ ভাইরাস ছড়াচ্ছে! যদি বলি কেন ছড়াচ্ছে, তবে নানা কারণ বের হবে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই গণমাধ্যমের রগরগে উপস্থাপন। আমাদের দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমই সংবাদ অন্য সব খবরের সঙ্গে ধর্ষণের সংবাদ বা অপরাধ বিষয়ক সংবাদকে গুলিয়ে ফেলে। আমরা জানি তথ্যে সমৃদ্ধ হয় সংবাদ। অর্থাৎ সংবাদসংশ্লিষ্ট যত বেশি তথ্য দেওয়া যায়, সংবাদটি তত মজবুত হবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে কি এটা প্রযোজ্য? অপরাধবিষয়ক সংবাদে আমরা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন কিছু তথ্য দিই, যেটার মাধ্যমে অন্য কোনো অপরাধী কৌশলটি আয়ত্ত করে নেয়। যেমন- একটি ধর্ষণের সংবাদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হলো, ‘মেয়েটি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হলে ওঁৎপেতে থাকা যুবক জোর করে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে ধর্ষণ করে (এখানে আরো অনেক নতুন কৌশলের কথা ইচ্ছে করেই প্রকাশ করা হলো না)। এ সংবাদ পাঠের পর ধর্ষণের ইচ্ছে আছে অথচ সুবিধামতো উপায় পাচ্ছে না এমন যুবকেরও কিন্তু কৌশলটি আয়ত্ত হয়ে যায়। তখন সে এটি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ হয়।

আবার দেখুন, কয়েকদিন আগে ফেনীর সোনাগাজীতে যখন মাদরাসার প্রিন্সিপাল কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও শেষে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার খবর ভাইরাল হলো, এর পরই দেশজুড়ে যেন মোল্লা-মৌলভীদের অপরাধ হু হু করে বাড়তে থাকল। এরপর থেকেই ইমাম মোল্লাদের ব্যাপারে নেগেটিভ খবরে ভর্তি মিডিয়া।

অর্থাৎ ইমাম মোল্লারা ধরে নিয়েছেন এখন তাদের অপরাধ করার সময় এসেছে। অন্য মোল্লারা যেখানে অপরাধ করছে সেখানে তিনি (তুলনামূলক পরে অপরাধ করা মোল্লা) কেন পিছিয়ে থাকবেন? এখানেই শেষ নয়। থেমে রইলেন না অন্য ধর্মের কর্তাব্যক্তিও। ক’দিন বাদেই দেখলাম পুরোহিতও বাদ পড়েননি। যশোর সদর উপজেলার বিরামপুর গ্রামের ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র মন্দিরের ভেতরে শিশু ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে পুরোহিতকে আটক করা হয়েছে। ভেবেছেন কি হঠাৎ মোল্লা-পুরুতরা একযোগে এসব কাজে নেমে পড়লেন কেন? একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়, এর জন্য গণমাধ্যম দায়ী নয়তো? যদি হয়ে থাকে তাহলে করণীয় কী? অপরাধের সংবাদ তো প্রকাশ করতে হবে। না হলে অপরাধীরা চিহ্নিত হবে না। পার পেয়ে যাবে। আবার প্রকাশ করলে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। এর সমাধানে গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে গণমাধ্যমই। একটু সতর্কতার সঙ্গে সংবাদটি পরিবেশন করলে এই প্রবণতা কিছুটা হলেও কমতে পারে।

এক্ষেত্রে অপরাধ বা ধর্ষণবিষয়ক কোনো সংবাদ পরিবেশনের সময় ন্যূনতম তথ্য দিয়ে অপরাধীর শাস্তি বা এর পরিণতির কথা তুলে ধরা যেতে পারে। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে সাহায্য করে এমন তথ্য যুক্ত করা যেতে পারে। মূল কথা হচ্ছে— সংবাদ পড়ে যেন মানুষ অপরাধে নিরুৎসাহিত হয় এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে। জাতির বিবেক খ্যাত এ পেশার মানুষের জন্য এতটুকু নিশ্চয়ই বেশি নয়। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এতটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি। সব অপরাধ দমনে অগ্রণী ভূমিকার দৃষ্টান্ত হোক গণমাধ্যম।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads