• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সাম্প্রদায়িকতার বলি সাধারণ মানুষ

শ্রীলংকায় সিরিজ বোমা হামলা

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলা

সাম্প্রদায়িকতার বলি সাধারণ মানুষ

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৯

যে কোনো ধর্মের, যে কোনো বর্ণের মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। মানুষকে নির্বিঘ্নে তার ধর্ম পালন করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু একশ্রেণির মানুষ পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ এসব মানুষের অন্তর। আর এই শ্রেণির মানুষের কারণে বিশ্বব্যাপী মাঝে মাঝেই সংঘটিত হয় নানান সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা। সম্ভবত তেমনি একটি অপতৎপরতা ছিল ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় শ্রীলঙ্কায় তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বোমা হামলা। আকস্মিক এই হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৯০ (সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী)।  এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন বিদেশি রয়েছেন। এএফপির খবরে পুলিশ এ তথ্য জানিয়েছে। হাসপাতাল ও পুলিশের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, ঘটনায় আহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে।

গত ২১ এপ্রিল রোববার সকালে রাজধানী কলম্বো ও তার পাশের তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে ইস্টার সানডে পালনের জন্য সমবেত হয় কিছু মানুষ। ইস্টার সানডে পালনকালে এই বিস্ফোরণ ঘটে। আক্রান্ত গির্জা তিনটি হচ্ছে কচিহিকাডে, নিগমবো ও বাটিকালোয়া। হোটেল তিনটি হলো কলম্বোর শাংগ্রিলা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবারি। পুলিশ জানিয়েছে, শুধু কলম্বোর উত্তরের সেন্ট সেবাস্টিয়ান গির্জাতেই নিহতের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। বাটিকালোয়া গির্জায় আরো ২৫ জন নিহত হয়েছেন। দুপুরে একটি হোটেলসহ আরো দুটি জায়গায় বিস্ফোরণের খবর জানায় কলম্বো পুলিশ।

শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। হিন্দু ১২ দশমিক ৬ শতাংশ; ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলমান ও ৭ দশমিক ৬ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কায় কেবল ৬ শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। এই নৃশংস বোমা হামলার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গির্জাটির ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গির্জার বেঞ্চে রক্ত লেগে রয়েছে। মেঝেতে লাশ ছড়িয়ে রয়েছে। নিগমবো অঞ্চলের কাতাওয়াপিতিয়ায় সেন্ট সেবাস্টিয়ান গির্জার ভেতরে বিস্ফোরণে ধ্বংসের ছবি দেখা গেছে এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে। এতে গির্জার ফ্লোরে রক্ত বয়ে যেতে দেখা গেছে। আক্রান্তদের সহায়তায় সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে। উদ্ধারকারীরা হতাহতদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। হতাহতদের মধ্যে বিদেশি পর্যটকরাও রয়েছেন বলে দেশটির স্থানীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে।

ইস্টার সানডের মতো একটি ধর্মীয় উৎসব পালন করার সময় এই হামলা ছিল অচিন্তনীয়। হামলাটি ছিল মারাত্মক। কোনো রকম আত্মরক্ষার প্রস্তুতির সুযোগ উপস্থিত ব্যক্তিরা পাননি। তারা ধর্মীয় আচারাদি পালনে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় যে এমন একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারে তা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এ ঘটনায় হামলার দায় এখনো কেউ স্বীকার করেনি। তবে শ্রীলঙ্কা পুলিশ এ পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের গ্রেফতারের কারণ ও নামধাম পুলিশ জানায়নি। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ খবর জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। আর আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুয়ান জয়াবর্ধনা।

শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন ধরে একটি অশান্ত দেশ ছিল। ২০০৯ সালে তামিল টাইগার গেরিলাদের সঙ্গে সেনাদের লড়াইয়ের সময় দেশটিতে প্রায়ই বোমা হামলার ঘটনা ঘটত। প্রায় এক দশক আগে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। তারপর থেকে দেশটিতে এ-জাতীয় কোনো সমস্যা ছিল না। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর এই প্রথম দেশটিতে বড় ধরনের বোমা হামলা হলো। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত হতচকিত হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ।

বোমা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার দিন বিকেলে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা আহ্বান করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। তাছাড়া টুইটারে এক টুইটে সিরিসেনা বলেন, ‘আজ আমাদের জনগণের ওপর যে কাপুরুষোচিত হামলা হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানাই। এই দুঃখজনক সময়ে সব শ্রীলঙ্কানকে এক হওয়ার ও শক্ত থাকার আহ্বান জানাই। দয়া করে যাচাই-বাছাই না করে বিকৃত ও ধারণাপ্রসূত প্রচারে কান দেবেন না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে।’

ইস্টার সানডের প্রার্থনার সময় শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা এবং গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি নিহতদের আত্মার শান্তি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন। তিনি শ্রীলঙ্কা সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন বলে রোববার বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো ও এর বাইরে সিরিজ বোমা হামলায় শতাধিক মানুষ নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা জানিয়ে হতাহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন অনেক রাষ্ট্রনেতা।

ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী হামলার নিন্দা জানিয়ে টুইট করেছেন। সেই সঙ্গে কাপুরুষোচিত এই হামলায় হতাহতদের জন্যও শোক প্রকাশ করেছেন তারা। নিন্দা প্রকাশ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমাদের ধর্মে এ ধরনের বর্বরতার কোনো স্থান নেই। শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে থাকবে ভারত। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে আমি একাত্ম ও আহতদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করি।

ইস্টার সানডের দিনে এই হামলায় বহু অমূল্যপ্রাণ ঝরে গেল এবং শত শত মানুষ আহত হলো উল্লেখ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার টুইটে বলেন, শ্রীলঙ্কায় আমাদের ভাইদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করছি। শ্রীলঙ্কার জনগণের শোকের সময় কাঁধে কাঁধ মেলাবে পাকিস্তান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিও হামলার নিন্দা জানিয়ে নির্দোষ নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় একাধিক বোমা হামলায় নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাচ্ছন্ন।

রাষ্ট্রনেতাদের বাইরেও বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হামলার নিন্দা জানিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। জানা যায়, হামলার বিষয়ে ১০ দিন আগেই দেশব্যাপী সতর্কতা জারি করেছিলেন শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুজিত জয়াসুন্দরা। গত ১১ এপ্রিল তিনি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আত্মঘাতী বোমা হামলার হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। সতর্কবার্তার পরও কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, কেন গির্জাগুলোতে প্রার্থনায় এত মানুষ সমবেত হলেন, লোক সমাগমের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো না তা বোধহম্য নয়। আর একটু সতর্ক থাকলে হয়তো এতগুলো জীবনহানি হতো না।

শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার ঘটনার পর থেকে এক শিশুসহ দুই বাংলাদেশি পর্যটকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র  প্রতিমন্ত্রী সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ওই দুজনের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করেননি তিনি।

তিনি বলেন, ওই দুজনের খোঁজে কলম্বোর হোটেল ও হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, চারজন বাংলাদেশির একটি দল কলম্বো গিয়েছিল ট্যুরিস্ট হিসেবে। তাদের মধ্যে দুজন ঠিকঠাক থাকলেও একটি শিশুসহ দুজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, একটা দীর্ঘ সময় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কায় শান্তি অর্জিত হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে আমরা শ্রীলঙ্কার পাশে আছি, থাকব। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না হয় সেজন্য আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

কিন্তু ওই নিখোঁজ দুজন হলেন বাংলাদেশের সাংসদ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের জামাতা ও তার ৮ বছরের সন্তান জায়ান। আমরা বেদনার্ত শিশু জায়ানের এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে। জায়ানের বাবা অর্থাৎ শেখ সেলিমের জামাতা মশিউল হক চৌধুরী আহত অবস্থায় শ্রীলঙ্কার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার আশু আরোগ্য কামনা করি। হামলার পর দেশটিতে ১২ ঘণ্টার (সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার ভোর ৬টা) কারফিউ জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল। এছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। গুজব এড়াতে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।

এ হামলায় কে বা কারা জড়িত তা অবিলম্বে বিশ্বসম্প্রদায়ের নজরে আসা দরকার। কারণ সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন শ্রীলঙ্কার নিরপরাধ মানুষের ওপর এই বোমা হামলার ঘটনায়। অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। বিশ্বের বিবেকবান মানুষ আর লাশের মিছিল দেখতে চায় না। বিশ্বমোড়লদের এখন নিজ স্বার্থ পরিহার করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। নতুবা দেশে দেশে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এর অবসানে জোটভুক্ত হয়ে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads