• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে শতরঞ্জির শোভা

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে শতরঞ্জির শোভা

প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৯

উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জেলা রংপুর। রংপুর জেলা শহর থেকে পশ্চিমে সেনানিবাসের পেছনে ঘাঘট নদীর কোলঘেঁষে বিশাল এক গ্রামের নাম নিসবেতগঞ্জ।

জানা যায়, গ্রামটির কিছু মানুষ ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে পাটের সুতার শতরঞ্জি বানানো শুরু করেন। পরে ব্রিটিশ আমলে ওই গ্রামের একটি পাড়ার নামই হয়ে যায় শতরঞ্জিপাড়া। হাল আমলে এসে রঙে-রূপে-আদলে বদলেছে শতরঞ্জির আভিজাত্য। আধুনিক সময়, চাহিদা ও রুচির সাথে সমন্বয় রেখে নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জির বাহারি পণ্য। চিরায়ত বাংলার নয়নাভিরাম নকশার শতরঞ্জির নান্দনিকতা এখন আধুনিক বাংলাদেশে এমনকি বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। শ্রমঘন এবং স্বল্প পুঁজির ব্যবসা হওয়ায় অনেকে ঝুঁকছেন এই শিল্পে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পটি আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করেন। দেশের গৃহসজ্জায় শতরঞ্জির বিপুল চাহিদা শিল্পের বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখছে। যার ফলে কালক্রমে সেই শতরঞ্জিপাড়া এখন শতরঞ্জিপল্লী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

কোনো প্রকার যান্ত্রিক ব্যবহার ছাড়াই কাঠের ফ্রেম আর রশি দিয়ে সুতা গণনা করে হাত দিয়ে বাহারি নকশা করে তৈরি হয় শতরঞ্জি। আগে শুধু ঘরের মেঝেতে বিছানোর জন্যই তৈরি হতো শতরঞ্জির পণ্য। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে একই বুননে তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জির ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, কুশন কভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশ, ঘর সাজানো এবং ব্যবহারের উপযোগী অনেক ধরনের পণ্য। শতরঞ্জিতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয় ঘটিয়ে ডিজাইন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই শতরঞ্জি রংপুর জেলা ব্র্যান্ডিং হয়েছে। রং-বেরঙের সুতার গালিচা দিয়ে উত্তরের এ জেলার পরিচিতি ঘটছে দেশ-বিদেশে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরের নিভৃত পল্লীতে উৎপাদিত শতরঞ্জিসামগ্রী ঢাকার বেশ কয়েকজন রফতানিকারকের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। জানা গেছে, প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্পসামগ্রী রফতানি হয়, তার ৫০ ভাগই শতরঞ্জি। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়াসহ বিশ্বের ৩৮টি দেশে রফতানি হচ্ছে। বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘আইকা’ বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শতরঞ্জিসামগ্রী আমদানি করে ইউরোপের চাহিদা পূরণ করেছে। চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ‘আইকা’ ছাড়াও বিবি রাসেল ও কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এই শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী শতরঞ্জি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ, শিল্প এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তারা শতরঞ্জি কারখানা গড়ে তুলতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের মতে, সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে দেশের কাঁচামাল দিয়ে এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আয় এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবে এই শিল্প।

নিসবেতগঞ্জ গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার উল ও সুতার শতরঞ্জি বুনে আজ স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে রংপুরের অন্য এলাকাতেও অনেকে শতরঞ্জি তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।  এই শিল্পকে ঘিরে শহরের উপকণ্ঠে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠেছে শতরঞ্জিপল্লী। চাহিদা বৃদ্ধির সুবাদে কারুপণ্যের উদ্যোগে শহরের রবার্টসনগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও  জেলা সদর, কুড়িগ্রাম এবং উলিপুর পৌর এলাকায়ও গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি কেন্দ্র। প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শত শত পিস শতরঞ্জি উৎপাদন করা হচ্ছে।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রফতানি করে আয় হয় ২০ হাজার ডলার। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয় শ্রমিকদের ডিজাইনে করা শতরঞ্জি রফতানি করে প্রতি বছর অর্জিত হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রংপুর জেলার তাঁতিরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করে যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি বা ডুরি মূলত এক প্রকার কার্পেট, এক সময়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহূত হতো। বর্তমান আধুনিত সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো ব্যবহূত হচ্ছে। শতরঞ্জি ফার্সি ভাষার শব্দ শতরঞ্জ শব্দ থেকে এসেছে। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সাথে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে এটাকে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়। ইংরেজিতে যাকে Coursestripea Corm Carpet বলা হয়। শতরঞ্জি শুধুমাত্র রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশেরও ঐতিহ্যবহনকারী এক বিশেষ পণ্য।

আশার খবর হচ্ছে রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের হস্তশিল্প শতরঞ্জি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ডলার আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজারো মানুষের। প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পটি। স্ব-পেশায় ফিরে আসছেন পুরনো এই শিল্পের কারিগররা। শতরঞ্জির ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, প্রথম সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারিভাবে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে। এরপর থেকে অবহেলিত শতরঞ্জি শিল্পটি সরকারের দৃষ্টিতে আসেনি। বলা যায় অবহেলার শিকার হয়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া শিল্পটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে বেসরকারি উদ্যোক্তারাই। তারপরও নানা প্রতিকূলতায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তবে বিসিকের উদ্যোগে এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিসিকের এই কেন্দ্রটি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে রংপুর শহরের কারুপণ্যের মালিক সফিকুল আলম সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরো বহুমুখী হয়ে ওঠে। তারও পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মধ্যদিয়ে খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপিয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির পরিচয় ঘটে। তবে শতরঞ্জি শিল্পকে জাগরিতকরণে যার ভূমিকা অনন্য তিনি শতরঞ্জির স্বপ্নদ্রষ্টা- কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম।  কেননা তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জি শিল্প বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলার ঐতিহ্য থেকে শৌখিন গৃহসজ্জার নান্দনিকতায়। তার দেখানো পথ ধরেই শতরঞ্জির শৈল্পিক কারুপণ্য রফতানির মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত লক্ষ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। সফিকুল আলম সেলিম শতরঞ্জি শিল্পের ২০ জন কারিগরকে খুঁজে বের করে রংপুরের নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা কারখানা ভাড়া নিয়ে ১৯৯১ সালেই রংপুরে কারুপণ্য নামের একটি দোকান দিয়ে ‘শতরঞ্জি’ বুননের নতুন জাগরণের গোড়াপত্তন করেন। শতরঞ্জির বিকাশ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা সফিকুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘শতরঞ্জি বিক্রির জন্য ব্যাপক প্রচারণা হয়েছে। সাড়া পেয়েছি ভালো। শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যমেলায় ক্রেতা-দর্শকদের বিপুল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’

শতরঞ্জিতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয় ঘটিয়ে ডিজাইন করা হয়। জানা  গেছে, ৬ থেকে ৯টি রঙের ৪০-৫০টি ডিজাইনের শতরঞ্জি বাজারে পাওয়া যায়। পাশাপাশি ইচ্ছা অনুযায়ী নতুন করে বা নিজের পছন্দের নকশা অনুযায়ী ফল, ফুল, কার্টুনের পায়ের ছাপ— এসব আকারের শতরঞ্জিও পাবেন।  শতরঞ্জির দাম নির্ধারণ করা হয় স্কয়ার ফিট হিসেবে। প্রতি স্কয়ার ফিট ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়, ক্ষেত্র বিশেষে দাম কমবেশিও হয়। রংপুরে রয়েছে শতরঞ্জির প্রায় ৩০টি দোকান। শতরঞ্জি পাওয়া যাবে ঢাকার শুক্রাবাদে, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, রাজধানী সুপার মার্কেট, গুলশান-২, ডিসিসি মার্কেট, গুলশান-১ নম্বরে। ফ্যাশন হাউস আড়ং, যাত্রাতে পাওয়া যাবে সুতার তৈরি ও মখমলের শতরঞ্জি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads