• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
একজন সঙ্গীতজ্ঞের যুদ্ধ ও গান

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

একজন সঙ্গীতজ্ঞের যুদ্ধ ও গান

  • মোমিন মেহেদী
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০১৯

গীতিকার, সুরকার বা বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই নন, নির্ভীক মানুষ হিসেবেও বরাবর আলোচিত ছিলেন সকল প্রজন্মের প্রিয় মানুষ সুরসম্রাট আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার অসংখ্য গান হাজার বছর বেঁচে থাকবে শুধু বাংলাদেশ ও তার মানুষকে ভালোবাসার জন্য। সব বয়সী মানুষের প্রিয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এতটাই জনপ্রিয় যে, এই ডিজিটাল সময়ে এসেও সেই অতীতের গানগুলোতে ফিরে ফিরে যায় বাংলাদেশের মানুষ। কেননা তিনি নিবেদিত ছিলেন গানের জন্য। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে বুলবুল তালিকাভুক্ত হলে তিনি বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘গান আসে সর্বোচ্চ ভালোবাসায়-সততায়। অসৎ মানুষ সঙ্গীতশিল্পী হলেও সঙ্গীতে টেকে না।’ নিরলস সঙ্গীতমুখী মানুষ হওয়ায় বুলবুলকে হারানোর বেদনায় যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ বাংলাদেশ। গানের অ্যালবাম তৈরি থেকে শুরু করে অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। উপহার দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য মানসম্মত গান, যা আজো শ্রোতামহলে বেশ জনপ্রিয়। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ ইতিহাস হয়ে থাকবে স্মৃতির পাতায়।

আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাস বলে, ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বুলবুল অসংখ্য গানে সুর করেছেন, যার অধিকাংশ গানই তার নিজের রচিত। এসব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সামিনা চৌধুরী ও জেমসসহ দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা। সুরসম্রাট আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভালোবাসার সঙ্গীতের রাজত্বজুড়ে রয়েছে— ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালি’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেম ভিখারি’, ‘ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে’, ‘আইলো দারুণ ফাগুনরে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হূদয়ে সুখের দোলা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়’, ‘নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে’, ‘চতুর্দোলায় ঘুমিয়ে আমি ঘুমন্ত এক শিশু’, ‘মাগো আর নয় চুপি চুপি আসা’সহ আরো অনেক গান।

গানের রাজত্ব তৈরি করেছেন নিজের সংসার বা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে। বয়ে চলেছেন নিমগ্ন নদীর মতো। অবিরত সেই বয়ে চলায় আজ যখনই মনে পড়ছে তিনি নেই, তখনই কানে বাজছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’। অনেক অভিমানী ছিলেন তিনি, ছিলেন নীরব প্রেমিকও। তার প্রেমের কারণে কম করে হলেও পাঁচশ গান পেয়েছে বাংলাদেশ। যে গানে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য। আজ যারা গানের আকাশে স্বমহিমায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই স্বীকার করেছেন যে, যদি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের গান না গাইতেন, তাহলে হয়তো এই অবস্থান নির্মিত হতো না। নীরব ভালোবাসায় সৃষ্টিশীল তার গানগুলোর মাঝে তিনি বেঁচে রবেন চিরকাল।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই একমাত্র কিশোর যিনি পরিবারের অনেক অপত্তি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন এবং বীরত্বগাথা ভূমিকা রাখেন। নিখাদ যোদ্ধা হওয়ায় তার প্রতিটি গানে নেমে এসেছে দেশের প্রতি ভালোবাসার জোয়ার। তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তবু বলবো যতটা সম্মান তার প্রাপ্য ছিল, দিতে পারেনি বাংলাদেশ। সম্মান দিতে এই কার্পণ্য বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়— অকুতোভয় হয়ে দ্রুত বিচার আদালতে তার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা। স্মরণ করিয়ে দেয়, তার খেদ আর নিরাপত্তাহীন দিনগুলোর কথা। ভাই হারানোর কথা। তবু একটি কথাই শুধু আমি বলে যেতে চাই, বাংলা আমার আমি যে তার আর তো চাওয়া নাই রে...আর তো চাওয়া নাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads