• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
নাফিউরের ছুটে চলা

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

নাফিউরের ছুটে চলা

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০১৯

খন্দকার নাফিউর রহমানের বয়সটা কেবল উনিশ। জন্মের সময় থেকেই সংগ্রামের মধ্যে জীবন পাড়ি দেয় ছেলেটি। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করে নাফিউর। তার মা নাদিয়া আক্তার একজন গৃহিণী। বাবা খন্দকার মাহবুবুর রহমান মুদি দোকানদার। তাদের বাড়ি হাটচন্ডা গ্রাম, জামালপুর সদর, জামালপুরে।

ছোটবেলা থেকেই নাফিউর রহমান ছিল অবহেলার পাত্র। নাফিউররা যমজ ভাই-বোন। জন্মের সময় এক পা ছাড়াই জন্মায় সে। সারা গ্রামে এ খবর রটে যায়। শিশুবেলা থেকে নাফিউর ছিল সবার উপহাসের পাত্র। গ্রামের মানুষ মনে করত যে ছেলেটির জন্মই এক পা ছাড়া, সে জীবনে কতটুকুই পা চলতে পারবে।

কিন্তু মানুষের অবজ্ঞায় সে-ই পিছিয়ে পড়ে, যে হারার জন্য ধরণীতে আসে। আর যারা মানুষের অবজ্ঞাকে নিজের শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, সে-ই বিজয়ী হয়। নাফিউর দ্বিতীয় পন্থাটিই বেছে নিয়েছিল। নাফিউরের বাসার সামনেই বিদ্যালয়। নাফিউরের বয়স যখন চার, তখন হামাগুড়ি দিয়েই বিদ্যালয়ের দিকে যেত সে। এলাকার সবাই অবাক হয়ে যেত। তার মা নাদিয়া ছেলের বিদ্যালয়ের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে নিজেই বাঁশ কেটে দুটি লাঠি বানিয়ে দেন। নাফিউর সেই লাঠির ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমদিকে ছেলেটির দাঁড়াতে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু অদম্য ইচ্ছায় লাঠির ওপর ভর করে হাঁটতে শিখল সে। এভাবে নাফিউর স্কুলে যাওয়া শুরু করল। তার এ প্রচেষ্টায় প্রশংসা তো দূরে থাক, উল্টো তাকে নিয়ে উপহাস আরো বেড়ে যায়।

অনেকে বলতে লাগল, এভাবে এই ছেলে আর কতদূর আগাবে। রাস্তায় অনেক ছোটরা দেখে ভয় পেত। তখন নাফিউর আবার হতাশ হয়ে পড়ত। মনে একরাশ অভিমান জমে থাকত তার। তাও মুখ বুজে সব সহ্য করত সে। নাফিউর দেখত তার বন্ধুরা সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসছে। তা-ই দেখে নাফিউর ভাবতো- ইস, আমি যদি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারতাম, তাহলে কি মজাই না হতো!

ক্লাস নাইনে জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। নাফিউরের চাচা তাকে একটি ছোট্ট সাইকেল কিনে দিলেন। প্রথমে সাইকেলে উঠতে গিয়ে ব্যালান্স ঠিক রাখতে না পারায় বার বার পড়ে যাচ্ছিল সে। পরে তার চাচা তাকে সাইকেলের পেছনে ধাক্কা দিত আস্তে আস্তে, যাতে নাফিউরের সাইকেল চালানোয় অসুবিধা না হয়। এ কাজেও সফল হয় অদম্য জেদী ছেলেটি। স্কুল থেকে এসে প্রতিদিন নাফিউর সাইকেল চালানো কসরত করত।

হাইস্কুলে থাকতেই সাঁতারে পটু হয়ে ওঠে সে। জামালপুর জেলার হাইস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হয় ছেলেটি।

ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তীব্র ঝোঁক ছিল ছেলেটির। জামালপুর জেলা স্কুল মাঠে ছেলেরা যখন ক্রিকেট খেলত, তখন নাফিউরের খুব ইচ্ছে করত বোলিং করার। একদিন সাহস করে বল করেও ফেলে। তার বোলিং দেখে অবাক হয় সবাই। এভাবে ‘জামালপুর নতুন আলো ক্রিকেট একাডেমি’তে খেলতে থাকে নাফিউর। এরই মধ্যে ‘রবি-খোঁজ, দ্য এক নম্বর স্পিনার’-এ জামালপুরে সেরা ২০ স্পিনারের মধ্যে জাযগা করে নেয় সে। ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিবন্ধীদের মধ্যে সেরা স্পিন বোলার নির্বাচিত হয়। এরপর বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট টিমে যোগদান করে।

নাফিউরের লক্ষ্য, আগামী ২০২০ সালে ‘আইসিডব্লিউসি ওয়ার্ল্ড কাপ থাইল্যান্ড’-এ হুইল চেয়ার ক্রিকেটে নিজের মেধা তুলে ধরবে। দলকে নিয়ে যাবে চ্যাম্পিয়নের তালিকায়।

বাংলাদেশ প্যারা ব্যাডমিন্টন দলেও খেলা শুরু করেছে নাফিউর। ২০২১ সালে অলিম্পিক প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টেও ছেলেটি নিজের ঝলক দেখাবে। 

সাইকেল ছেড়ে মোটরসাইকেল চালনায় পারদর্শী ছেলেটি। এখন নাফিউর ইসলামপুর সরকারি কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ১৯ বছর বয়সী নাফিউর স্বপ্ন দেখে নিজেকে দেশের তরে বিলিয়ে দেবেন। সে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটে, মোটরসাইকেল চালনায়, সাঁতারে, ব্যাডমিন্টনে একজন সাধারণ মানুষের চাইতেও বেশি ঝলক দেখাচ্ছে নাফিউর। সে দেখিয়ে দিয়েছে একজন মানুষ চেষ্টা করলে কী না পারে! নাফিউর জানায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার মতো অনেকেই আছে, যারা নিজেদের মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারছেন না। তাদের যদি তুলে আনা যায়, ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে তারাও বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads