• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ইতিহাস ঐতিহ্যের দীপ্তিময় ভাস্বর

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

ইতিহাস ঐতিহ্যের দীপ্তিময় ভাস্বর

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২০ আগস্ট ২০১৯

শতবর্ষের নানান ঐতিহ্যে লালিত সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক জনপদটির নাম গাজীপুর। গাজীপুর জেলার আয়তন ১ হাজার ৭৪১ বর্গকিলোমিটার। জেলার উপজেলাগুলো হচ্ছে গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, শ্রীপুর, টঙ্গী ও জয়দেবপুর। জেলার উত্তরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ, পূর্বে কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী, দক্ষিণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এবং পশ্চিমে ঢাকা ও টাঙ্গাইল। পুরনো ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বংশী, বালু এই জেলার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নদী। ঐতিহাসিক ভাওয়াল পরগনার গহিন বনাঞ্চল আর গৈরিক মৃত্তিকা কোষের টেকটিলায় দৃষ্টিনন্দন গাজীপুর ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর গাজীপুর উন্নীত হয় মহকুমায়। মহকুমা এবং জেলা হিসেবে উন্নীত হওয়ার আগে এলাকাটির নাম ছিল জয়দেবপুর। তখন তা ছিল থানা সদর। কিন্তু ঐতিহাসিক জনপদ হিসেবে সুদূর অতীত থেকে এলাকাটি পরিচিত ছিল কখনো ভাওয়াল, কখনো ভাওয়াল বাজুহা অথবা কখনো ভাওয়াল পরগনা হিসেবে। আর ঐতিহাসিক জনপদ হিসেবে ভাওয়ালের সীমানা কেবল বর্তমানের গাজীপুর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ভাওয়াল তথা গাজীপুরবাসী রেখেছে বীরত্বপূর্ণ অবিস্মরণীয় ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরেই সংঘটিত হয়েছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকিস্তানি দখলদার বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির পক্ষ থেকে সেদিনই প্রথম গর্জে উঠেছিল বন্দুক। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার সুযোগ্য সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদ এই অঞ্চলের গর্বিত সন্তান। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ তৎকালীন সরকারের মুখ্য অর্থসচিব এম সাইদুজ্জামান নতুন গাজীপুর জেলার উদ্বোধন করেন। আয়তনের দিক থেকে ঢাকা বিভাগের ১৭ জেলার মধ্যে গাজীপুরের অবস্থান সপ্তম এবং বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর ৩৯তম।

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জেলা

গাজীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। গাজীপুর বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। মোগল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গাজীপুরের রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর কোলঘেঁষা গাজীপুর জেলা আরো নানাবিধ কারণে প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে গাজীপুরের মাটিতেই সংঘটিত হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এই জেলায় রয়েছে অনেকগুলো জাতীয় পর্যায়ের ও আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা আঞ্চলিক কেন্দ্র, তুলা গবেষণা প্রশিক্ষণ ও বীজবর্ধন খামার, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, টেলিফোন শিল্প সংস্থা এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই উপমহাদেশের আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হাই সিকিউসিটি কেন্দ্রীয় কারাগার গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুরে উপস্থিত। শিল্প ও জ্ঞানের আলো বিস্তারের কেন্দ্রভূমিরূপে গাজীপুরের অবস্থান এক অনন্য উচ্চতায়। ছাত্র সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরের বোর্ড বাজারে অবস্থিত। এই বোর্ড বাজার এলাকায় আন্তর্জাতিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট অবস্থিত। এছাড়া গাজীপুরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, টেলিকম স্টাফ কলেজ, আইটি পার্ক, দেশের একমাত্র ডাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রোভার ও স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গাজীপুরে অবস্থিত।

বন-বনানীর ছায়ায় ঘেরা

নানা প্রজাতির গাছপালায় সমৃদ্ধ দেশের শিল্পোন্নত গাজীপুর জেলা। নদী, বিল, টেক, টিলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি ঢাকার প্রতিবেশী এই জেলায়। শাল-গজারি, আম-কাঁঠাল ছাড়াও বহু প্রজাতির গাছ রয়েছে এ জেলায়। এখানকার শাল-গজারি, তাল, আম, কাঁঠালের বনবীথিকার দৃষ্টিনন্দন শোভা যে কারো মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। গাজীপুরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই সাফারি পার্কের উন্মুক্ত বাঘ, ভালুক, সিংহ, জিরাফসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রাণী ও জীবজন্তু দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ আসে। এ জেলায়ই আছে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। এ ছাড়া সময় পেলে কাপাসিয়া উপজেলার শীতলক্ষ্যার বুকে গড়ে উঠা ধাঁধার চরে ঘুরে আসতে পারেন। গাজীপুরেই আছে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লী, অভিনেতা তৌকীর-বিপাশা দম্পতির নক্ষত্রবাড়ী, গ্রীনটেক রিসোর্ট, দিপালী রিসোর্টসহ একাধিক রিসোর্ট। শ্রীপুরের শান্তিকুঞ্জ, মমতাজ শুটিং স্পট, সিগালসহ অসংখ্য স্পট, কালিয়াকৈরের নন্দন পার্ক, সোহাগ পল্লী, আনন্দ রিসোর্ট, গুলবাগিচা, রাঙামাটি ওয়াটার ফ্রন্ট। সারা বছরই পিকনিকসহ নানা অনুষ্ঠানের জন্য এসব ট্যুরিস্ট স্পটে ভিড় লেগে থাকে।

দুই হাজার বছরের প্রাচীনতম জনপদ কাপাসিয়া

বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাচীনতম জনপদের নাম কাপাসিয়া। এদেশের প্রাচীন ভূখণ্ডগুলোর অন্তর্ভুক্ত কাপাসিয়ার সমগ্র অঞ্চল। কাপাসিয়া বাংলাদেশের প্রাচীন এলাকাগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এলাকা, যার রয়েছে সুদীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস। ধারণা করা যায়, কাপাসিয়ার জন্ম প্রায় দুই হাজার বছর আগে। মুসলিমপূর্ব যুগ থেকে সমগ্র মুসলিম শাসনামলে উত্তরে টোক থেকে পূর্বে কিশোরগঞ্জ ও দক্ষিণে সোনারগাঁ পর্যন্ত এলাকাজুড়ে উৎপাদিত হতো ইতিহাস বিখ্যাত কিংবদন্তির মসলিন কাপড়। সেই অতি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের জন্য মিহি আঁশের কার্পাস তুলা উৎপাদিত হতো শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে। এই কার্পাস শব্দ থেকে কাপাসিয়ার নামকরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন। কাপাসিয়া ছিল মসলিন উৎপাদন ও বিক্রির জন্য একটি বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। কাপাসিয়া অঞ্চল ঐতিহাসিককালে কখনো সমৃদ্ধ জনপদ, কখনো গভীর অরণ্য, কখনো নদীগর্ভে বিলীন, আবার কখনো নতুন নতুন ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। কাপাসিয়া উপজেলার ভূমি গঠন, জনবসতি, প্রাকৃতিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। শ্রীপুর উপজেলার কর্নপুরে এবং কাপাসিয়া উপজেলার বাড়ির চালায় (বর্তমানে বারিষাব ইউনিয়নের গিয়াসপুর) এখনো সেই আমলের বিরাট দিঘি রয়েছে। টোক বা তাগমা সে সময়ে ছিল জমজমাট বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বানিয়া রাজারা এই এলাকায় প্রায় চারশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ১৯১৪ সালে প্রথমে শ্রীপুরে একটি ছোট পুলিশ ইনভেস্টিগেশন সেন্টার খোলা হয়। তৎপরবর্তী পর্যায়ে ১৯৩৩ সালে ৭ই অক্টোবর শ্রীপুরকে পূর্ণাঙ্গ থানা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯১০ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে কাপাসিয়াকে কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর- এ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে কাপাসিয়া থানাকে ভেঙে তিন থানায় বিভক্ত করেন। কাপাসিয়া উপজেলার বর্তমান আয়তন ৩৫৬.৯৮ বর্গকিলোমিটার।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ

১৯ মার্চ, বুধবার। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জয়দেবপুর তথা গাজীপুরের বীর জনতা। যুদ্ধে চারজন শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরো অনেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আন্দোলন দুর্বল করতে অন্যান্য সেনানিবাসের মতো জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের কৌশলে নিরস্ত্র করার জন্য তাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় ঢাকা ব্রিগেড সদর দপ্তর। কিন্তু মুক্তিকামী বাঙালি সৈন্য ও স্থানীয় জনতা তাদের মতলব বুঝতে পেরে অস্ত্র জমা না দিয়ে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। ১৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সতর্কতা ও রাস্তায় আন্দোলনকারীদের দেখে অস্ত্র জমা নেওয়ার আশা ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। এ সময় ছাত্র-জনতা জয়দেবপুরের রেলক্রসিং এলাকা ও চান্দনা চৌরাস্তায় তাদের বাধা দেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুড়লে ছাত্র-জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন হুরমত, নিয়ামত, কানু মিয়া ও মনু খলিফা। আহত হন আরো অনেকে। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম। তখন স্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ।

অনুপ্রেরণা ১৯

লুঙ্গিপরা বয়স্ক কৃষকের হাতে বল্লম, কিশোরের হাতে বাঁশের লাঠি, তার পাশেই টগবগে এক যুবক- হাতে দোনলা বন্দুক। তাদের পেছনে বাঁ হাতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পতাকা, আর ডান হাতে সেবাদানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেরণাদায়ী এক নারী। সবুজ প্রশস্ত মাঠের মাঝখানে সাড়ে তিন ফুট উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে এই চার যোদ্ধা সাক্ষ্য দিচ্ছেন ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের সেই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের। সেই স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য গাজীপুর সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্মারক ভাস্কর্য ‘অনুপ্রেরণা ১৯’। জেলা প্রশাসকের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে এ ভাস্কর্যটি নির্মাণে সময় লেগেছে প্রায় তিন মাস।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads