• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু

  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৯

শাহ রাজন

 

 

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা হলো কোনো শিশু বা ব্যক্তির স্বল্প বুদ্ধি, বয়সানুপাতিক আচরণের অক্ষমতা। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। এটি একটি বিকাশজনিত বুদ্ধি সমস্যা। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বয়স অনুযায়ী বুদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম থাকে। ফলে এদের বয়সানুপাতিক বৃত্তিমূলক কাজ, খেলাধুলা, লেখাপড়া, সামাজিক আচার-আচরণ, মেলামেশা, নিজের যত্ন নেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে কম দক্ষতা ও সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। এই সমস্যা একজন লোকের ১৮ বছর বয়সের আগেই দেখা দেয়। সাধারণভাবে বলা যায় সে তার বয়সের তুলনায় বুদ্ধিমত্তা ও অন্য সক্ষমতার দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে।

এসব সমস্যার শুরু সাধারণত শিশুকাল থেকে এবং তা ১৮ বছরের আগেই প্রকাশিত হয়। এটি একটি আজীবন সমস্যা। বুদ্ধি পরিমাপ ও মানিয়ে চলার দক্ষতা যেমন যোগাযোগ দক্ষতা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষাগত ও অন্য কাজের দক্ষতা, সমাজে নিজেকে মানিয়ে চলার দক্ষতা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে মানসিক প্রতিবন্ধিতার ধরন সামান্য থেকে তীব্র ধরনের হতে পারে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কারণও বিভিন্ন রকম হতে পারে। জন্মগত ও বংশগত ত্রুটি থেকে শুরু করে প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর বিভিন্ন জটিলতা থেকে এর উৎপত্তি। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতা, দরিদ্রতা এবং সুবিধাবঞ্চিতভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশও এর জন্য দায়ী।

আমাদের দেশে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুরা অনবরত পারিবারিক, সামাজিক অবহেলার শিকার। প্রায়ই তারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কেউ তাদের অবস্থার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন নাশকতামূলক ও অপরাধমূলক কাজে (অন্যের বাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা নিক্ষেপ ইত্যাদি) প্ররোচিত করে। অনেক সময় মেয়ে প্রতিবন্ধী শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে তাদের আত্মীয়-স্বজন ও অপরিচিতজনের দ্বারা।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের রয়েছে বহুমাত্রিক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন ধরনের শিশু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় তিন-চারগুণ বেশি। এদের মধ্যে অতিমাত্রার অমনোযোগিতা ও অস্থিরতা, আচরণগত সমস্যা যেমন- ভাঙচুর ও সহিংস আচরণ, আবেগজনিত সমস্যা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব শিশুর শতকরা ২৫ থেকে ৫০ শতাংশের খিচুনির সমস্যা রয়েছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নিবেদিত সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন কর্মসূচির সঙ্গে যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা জড়িত, তাদের এই দিকটির দিকে সতর্কভাবে খেয়াল রাখতে হবে। যদি এসব কর্মসূচিতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না থাকে, তবে তাদের কর্মসূচির সফলতা অনেকাংশে ব্যাহত হবে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানীর সম্মিলিত উদ্যোগে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের সহায়তা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধি পরিমাপকের জন্য সর্বজনীন কোনো পদ্ধতি এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি বুদ্ধি পরিমাপক বাংলায় অনুবাদ করে এদেশে ব্যবহূত হচ্ছে যা আমাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী জরিপ চালিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি তৈরি করা প্রয়োজন যা সবাই ব্যবহার করতে পারবে।

সময়মতো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাদের কর্মদক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে শিশু জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কিছু শারীরিক পরীক্ষা ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেওয়ায় শুরুতেই এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। দেশি-বিদেশি গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, বেশরিভাগ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার কারণ প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর বিভিন্ন জটিলতা। এজন্য আমাদের দেশের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি প্রসবকালীন সেবা কর্মসূচির সঙ্গে বিষয়টি সমন্বয় করা জরুরি।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুর পরিচর্যার শুরু নিজ পরিবারের ভেতর থেকে। তাদের প্রয়োজন ভালোবাসা ও উদ্দীপনাপূর্ণ পরিবেশ এবং সহযোগিতা। অভিভাবকদের বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ও প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কীভাবে আচরণ পরিবর্তন পদ্ধতি প্রয়োগ করে এবং তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। তাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক, বৃত্তিমূলক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। অভিভাবকদের একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হচ্ছে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আনন্দ ও সামাজিকতা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সব সময় যেন এ  কাজে ব্যয় না হয়। অন্যথায় একসময় তারা ভেঙে পড়বে ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের যত্ন নেওয়ার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে।

 

চিকিৎসা সহায়তা কোথায় পাবেন

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন। এদের মধ্যে শিশু বিকাশ ক্লিনিক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (আইপিএনএ), সরকারি ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগ ও শিশুরোগ বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশুমাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মাতুয়াইল, ঢাকা এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, মিরপুর অন্যতম।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের সেবায় নিবেদিত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট, কাউন্সেলর, ভলান্টিয়ার, নীতিনির্ধারক এবং অন্য যারা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োজিত রয়েছেন, তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা বেশি উপকৃত হবে।

এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণের ঘোষণা প্রভৃতি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার নির্মাণ করবে এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads