• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০১৯

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। তেমনি যুগের আধুনিকতার সঙ্গে মানুষের মনও আধুনিক হয়।  মানুষ এখন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। যৌথ পরিবারের প্রতি সবার একটা অনীহা। মানুষ একা থাকতে পছন্দ করে। গতানুগতিক সংঘবদ্ধ পরিবার যাচ্ছে ভেঙে। পরিবার ও সমাজ এমনকি ব্যক্তিবিশেষে হচ্ছে নানা ধরনের পরিবর্তন। চাহিদার বৈচিত্রায়নে মানুষের দিক-দর্শনে আসছে বিভিন্নমুখী নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য। জীবনবোধ সংসারকে করছে দিকভ্রান্ত ও ভিন্নমুখী। বৈশ্বায়নের চাপে এবং প্রভাবে মানুষ অনেক সময় নিজেকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। বৈশ্বায়নের প্রভাব, শিক্ষার প্রসার, প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিযোগিতা, সামাজিক সমস্যা, অর্থনৈতিক চাপ, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তির অত্যধিক উন্নয়ন ও ব্যবহার ইত্যাকার অবস্থা মানুষকে সংঘবদ্ধ অবস্থা থেকে ঠেলে দিচ্ছে একক জীবন চালনার দিকে। ঐ সকল একক ব্যক্তিদেরকে দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এই অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একটা বড় অংশের শেষ ঠিকানা হয় রাস্তার পাশে কিংবা মাজারে। আর ওই সব রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায়, অসুস্থ, পরিবারহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সম্পূর্ণ ফ্রিতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সুচিকিৎসাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা করার জন্য গড়ে উঠেছে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামক বৃদ্ধাশ্রম।

এই প্রতিষ্ঠান সমাজের অসুস্থ, অসহায়, পরিবারহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার, তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত করে। সমাজে সিনিয়র জনসাধারণ ও প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে নিজেদের সম্মান, সুন্দর জীবনবোধ, আত্মসচেতনতা, আনন্দের সঙ্গে সক্রিয় উদ্দেশ্য পূরণ করে সুস্থ সহনশীল জীবন যাপন করতে পারে তার ব্যবস্থায় অঙ্গীকারবদ্ধ এই প্রতিষ্ঠান।

শুধু রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ্য, অসহায়, পরিবারহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সম্পূর্ণ ফ্রিতে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার বৃদ্ধা আশ্রমে আশ্রয় প্রদান করা হয়। কোনো ব্যক্তি তার পরিবারের কোনো সদস্যকে উক্ত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বা রাখতে পারবে না।

এই প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে এলাকার দুস্থ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়সহ বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা খরচে পরিচর্যা, চিকিৎসা ও ঔষধ সরবরাহ করা। এতিম ও গরিব হারানো শিশু, পথশিশু পুনর্বাসন এবং থাকা খাওয়া ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা। মানসিক প্রতিবন্ধি, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র ও শিশু কেন্দ্র স্থাপন করা। চিকিৎসা, সহায়তা, ওষুধ ও চিকিৎসার দিকনির্দেশনা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রদান করা। কার্যক্রমের সুবিধার্থে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে যৌথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ও শিশুদের হোম সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শারীরিক দিক বিবেচনা করে খাবার সরবরাহ করা, প্রয়োজনীয় পোশাক সরবরাহ করা, তাদের চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ সরবরাহ করা, তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা। পথশিশুদের জন্য শেল্টার হোম ব্যবস্থা করা। নিজস্ব জমি ক্রয় করে বৃহৎ আকারে বৃদ্ধা আশ্রম স্থাপন করা। পথশিশুদের জন্য স্কুল-কলেজ স্থাপন করা। পথ শিশু, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ স্থাপন করা। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং আর্থিক সাহায্য প্রদান করা। এলাকার অবহেলিত দুস্থ, সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসা এবং দরিদ্রতা নিরসনে সহায়তা করা। নিরক্ষতা দূরীকরণ ও জীবনভিত্তিক শিক্ষার জন্য শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক ও অসামর্থ ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন এবং পুনর্বাসন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, পত্রপত্রিকা, সাময়িকা, বেতার, টিভিতে কথিকা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা করা।

ক্যানসার ও এইডস প্রতিরোধে কার্যক্রম গ্রহণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মানবসেবা দান, পুনর্বাসন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে সরকারকে সহযোগিতা করা। এতিম ও গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষা উপকরণসহ আর্থিক সাহায্য প্রদান করা। সমাজে বাল্যবিয়ে, বহুবিবাহ ও নারী নির্যাতন রোধসহ যৌতুকপ্রথা উচ্ছেদ করার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা। নির্যাতিত, তালাকপ্রাপ্ত, অসহায়, সম্বলহীন নারীদের পাশে থেকে সহযোগিতা প্রদান করা, তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বয়স্ক, শারীরিকভাবে অক্ষম এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র ও শিশু কেন্দ্র স্থাপন করা। মাদকের কুফল ও অপব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং পুনর্বাসন করা। অসহায় দুস্থদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপার্জনক্ষম করা। দুস্থ মহিলাদের উপার্জনের জন্য সেলাই মেশিন, হাস-মুরগি, ছাগল ইত্যাদি সরবরাহ করা। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বার্ষিক বনভোজনের ব্যবস্থা করা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে সহায়তা দান, মৃতের সৎকারের ব্যবস্থা করা। অসহায়, দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদযাপনে খাদ্যসামগ্রীসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান।

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ সম্পূর্ণ অলাভজনক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। তাই এই বৃদ্ধাশ্রমের সম্পূর্ণ খরচ বৃদ্ধা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মিলটন সমাদ্দারকেই বহন করতে হয়। মিলটন সমাদ্দার বৃদ্ধাশ্রমের সম্পূর্ণ খরচ তার ব্যক্তিগত ব্যবসা ‘মিলটন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড’ থেকে বহন করা হয়।

নিজ বাসায় বৃদ্ধ প্রিয়জনের পরিচর্যার প্রয়োজনে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি নার্সিং সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে গঠিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে মিলটন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড।

বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মিলটন সমাদ্দার বলেন, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার (বৃদ্ধা আশ্রম) অসহায় সুস্থ, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মানুষগুলোর সেবাদানের নিমিত্তে এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমার স্ত্রী আমাকে প্রতিষ্ঠানটি তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় অসহায়, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবা-পরিচর্যা প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত ১১৭ জন অসহায়, অসুস্থ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থাসহ সেবা-পরিচর্যা করে আসছি। বর্তমানে আরো ৬১ জন অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও তিন প্রতিবন্ধী শিশু আশ্রমটিতে আছে।

এটি একটি অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই না বৃদ্ধাশ্রমের মতো এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এ বিষয়টি একটি সমাজ ও দেশের জন্য লজ্জাজনক। এই অবহেলিত মানুষগুলো নিরাশ্রয়ী হওয়ার জন্য কে দায়ী? ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই দায়ী। এই বৃদ্ধ মানুষগুলোই তো আমাদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। এই দায় স্বীকার করে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের মূল বিষয় হলো রাস্তায় অসুস্থ, অসহায়, পরিবারহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আশ্রয় প্রদান করা যাতে এই অসহায় ব্যক্তিদের শেষ বয়সে একটু হলেও দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশা লাগব হয় এবং আপনার, আমার ভালোবাসায় বেঁচে থাকবে বাকি দিনগুলো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads