• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বিউটি বোর্ডিং একবেলা

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

বিউটি বোর্ডিং একবেলা

  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০২০

আলী মিনিস্টার

 

 

প্রথম দেখাতে হয়তোবা বিউটি বোর্ডিং আপনাকে খুব একটা আকৃষ্ট নাও করতে পারে। প্রধান ফটকটা ঘষেমেজে একটু সময়োপযোগী করা হয়েছে। সেটা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। হলুদ বর্ণের প্রাচীন আমলের গাঁথুনি মুহূর্তেই আপনাকে নিয়ে যাবে ১০০ বছর পেছনে।

মাঝখানে প্রশস্ত উঠোন। ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। বেশ আড্ডার জায়গা। পাশে খাবার ঘর, শোবার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর সবই গল্পের বইয়ে লেখা প্রাচীন জমিদারবাড়ি। আসলেই এটা একটা জমিদারবাড়ি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জামিদার পরিবারটি ভারতে চলে যায়। তখন এখানে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। সে সময় এখান থেকেই প্রকাশিত হতো সোনার বাংলা নামের একটি পত্রিকা। দেশভাগের পর বাংলাবাজার হয়ে ওঠে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তখন থেকেই বিউটি বোর্ডিং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায়। একসময় সোনার বাংলা পত্রিকাটির অফিস কলকাতায় চলে গেলে এর মালিক সুধীরচন্দ্র দাসের কাছ থেকে জায়গাটা বুঝে নেন প্রহ্লাদচন্দ্র সাহা ও তার ভাই নলিনীকান্ত সাহা। তারপর সোনার বাংলা প্রেসের জায়গায় শুরু হয় আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা।

চল্লিশের দশকে এই আড্ডা পুরান ঢাকায় সুখ্যাতি লাভ করে। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে এসেছিলেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। এসেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লেখেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশের পাণ্ডুলিপি। সমর দাস বহু গানের সুর তৈরি করেছেন এখানে বসে। শামসুর রাহমান লিখেছেন, মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।

এ ছাড়া আড্ডায় আসতেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, ফজলে লোহানী। আসতেন কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ও। সত্য সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, কবি আল মাহমুদ, শহিদ কাদরী প্রমুখ। ঐতিহাসিক বিউটি বোর্ডিংয়ে থেকেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। ১৯৭১ সালে সেই আড্ডায় ছেদ পড়ে পাকহানাদার বাহিনী জেনে যায় বাঙালির এই সাহিত্য সংস্কৃতির মানুষদের মিলনমেলার কথা। ২৮ মার্চ এখানেই শহীদ হন প্রহ্লাদ সাহাসহ আরো ১৭ জন।

যাইহোক, সাহিত্যের তীর্থক্ষেত্রের খাবার ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারি সারি টেবিল-চেয়ার। প্রতিটিতে স্টিলের বড় থালা আর গ্লাস রাখা। একসময় এখানে পিঁড়িতে বসে মেঝেতে থালা রেখে খাওয়া হতো। খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। হঠাৎ করেই শিহরণ জাগবে এই ভেবে একসময় যে ঘরে খেয়ে গেছেন বহু গুণী মানুষ, আজ সেখানে আপনিও বসেছেন পেট পূজাতে। তবে শিহরণ হারিয়ে যাবে সরষে ইলিশের ঘ্রাণে। জিহ্বায় পানি চলে আসবে মুহূর্তেই। খাবারের তালিকায় চোখ বুলালে পাবেন আরো অনেক পদ।

দুপুর বেলা খেয়ে বিকাল বেলা খুব সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল ও সদরঘাট। দুটি জায়গা বিউটি বোর্ডিং থেকে বেশি দূরে নয়। আহসান মঞ্জিলের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। বিউটি বোর্ডিংয়ে এখনো থাকার ব্যবস্থা আছে। রয়েছে ২৫টি কক্ষ। এক বিছানায়ালা রয়েছে ১২টি কক্ষ, এক রাতের জন্য ভাড়া ২০০ টাকা। বাকিগুলো দুই বিছানায়ালা কক্ষ, ভাড়া ৪০০ টাকা।

যেভাবে যাবেন- ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে গুলিস্তানে আসতে হবে। এখান থেকে বাসে চড়ে ৫ টাকায় অথবা রিকশায় ৩০ টাকায় বাহাদুর শাহ ভিক্টোরিয়া পার্ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে যে কাউকেই জিজ্ঞেস করল দেখিয়ে দেবে বিউটি বোর্ডিং।

যেখানেই যাই না কেন আপনার দ্বারা যাতে আশপাশের পরিবেশ বিনষ্ট না হয়ে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখি, নির্দিষ্ট জায়গায় যেন আমরা সবসময় ময়লা-আবর্জনা ফেলি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads