• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বসন্ত ছুঁয়েছে ভালোবাসা

ঋতুরাজ বসন্তের আগমন মুহূর্তে পলাশ ফুলে পাখির আনাগোনায় সুশোভিত হয়েছে রাজধানীর হাতিরঝিলের প্রকৃতি

ছবি: পিবিএ

ফিচার

বসন্ত ছুঁয়েছে ভালোবাসা

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাসন্তী ভাবনায় মনের বনে ফুল ফুটতে শুরু করেছে কদিন আগে থেকেই। আজ পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। শিমুল পলাশের রঙিন আবহে সুন্দরের প্রাচুর্য নিয়ে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। দখিন হাওয়ার গুঞ্জরণ এই মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরো কয়েক গুণ। বাসন্তী রঙের নানান ফুল প্রকৃতি রাঙিয়ে মাতাল হাওয়ায় দোল খেয়ে যায় সবার মনে মনে।

নতুন সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে পহেলা ফাল্গুন ১৩ নয়, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। এমন ভুলে গতকাল বৃহস্পতিবার অনেকেই বসন্ত বরণের জন্য পথে নেমেছিলেন। এ নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

এবার আরেকটি বিষয় খুবই মজার। বসন্ত শুরু ও ভালোবাসার দিন একাকার হয়ে গেছে। তাই আজ শুধুই ভালোবাসার দিন।

পুরনো বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বসন্তের প্রথম দিন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু পঞ্জিকা সংশোধনের পর এক দিন পিছিয়েছে বসন্ত। বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের কাজ করেছে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ। তারা জানিয়েছে, সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাস ৩১ দিন, কার্তিক থেকে মাঘ মাস ৩০ দিন এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিন ধরে গণনা করা হবে। তবে পশ্চিমা পঞ্জিকার লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন গণনা করা হবে।

এভাবেই ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। মাঘের শেষ দিক থেকেই গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। শীতের খোলসে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিচ্ছে বসন্ত এসেছে। এবং সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা।

‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল/চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়/বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়/স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে/জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে/নৌকা ডাঙায় বাঁধা, কান্ডারি জাগে/পূর্ণিমারাত্রির মত্ততা লাগে।/খেয়াঘাটে ওঠে গান অশ্বত্থতলে/পান্থ বাজায়ে বাঁশি আনমনে চলে।/ধায় সে বংশীরব বহুদূর গাঁয়/জনহীন প্রান্তর পার হয়ে যায়।/দূরে কোন শয্যায় একা কোন? ছেলে/বংশীর ধ্বনি শুনে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ফাল্গুন’ কবিতা এটি।

১৪২৬ বঙ্গাব্দের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুনের মানসপটে বার বার হানা দিচ্ছে কবিগুরুর এ ‘ফাল্গুন’। ঋতুরাজ বসন্ত আবাহনের ক্ষণযাত্রা। ফুলেল মধুময় ও যৌবনের উদ্যমতা বয়ে আনার বসন্ত, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বসন্ত।

স্বাগত বসন্ত। প্রাণ খুলে তাই যেন কবির ভাষায় বলা যায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়...।’ রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে- ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমার অশোকে কিংশুকে/অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে...।’

কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরাপাতার শুকনো নূপুরের নিক্বণ, প্রকৃতির মিলন এ বসন্তেই। বসন্ত মানেই যে পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা।

শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিময় বাতাস জানান দেয় নতুন লগ্নের। ফাল্গুনের আগমনে পলাশ, শিমুল গাছে লেগেছে আগুনে খেলা। মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব সর্বত্র। পুরো প্রকৃতিতে চলছে ‘মনেতে ফাগুন এলো...’ আবহ।

এমন ফাল্গুনেই, বায়ান্নর আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের ‘শব্দ বিপ্লব’, ‘সাহসী উচ্ছ্বাস’ ও বাঁধভাঙা আবেগে বাংলা একাকার হয়েছিল।

ঋতুচক্র এখন পঞ্জিকার অনুশাসন মানতে নারাজ! কুয়াশার চাদরে মোড়া শীত জেঁকে বসতে না বসতেই বিদায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুচক্রেও এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। সময়মতো শীত আসে না, বর্ষাও তা-ই। গ্রীষ্মের খরতাপও মানে না নিয়ম। এসবের মাঝেও অনেকটা স্বমহিমায় দীপ্যমান বসন্ত। প্রকৃতির এ আনন্দবার্তায় নাগরিক মনও তাই উচ্ছ্বসিত।

বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাউল কবির মনকেও বার বার দুলিয়েছে, দোলাচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত।

গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তের রঙে রঙিন। চোখ বুজলেও টের পাওয়া যায় এমন দৃশ্যপট। নাগরিক ইট-পাথরের জীবনে বসন্ত এসেছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে। এমন দিনে রমণীরা বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে তুলবে রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী। কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহুস্বর ধ্বনিত হবে ফাগুনের আগমনে। একই দিন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হওয়ায় নগরী পাবে অন্যরকম আবহ।

যানজট, কোলাহল ছাপিয়ে যেটুকু প্রকৃতি নগরে মেলে, এতেই গদগদ নগরের নাগরিকরা! যতই নিষ্প্রাণ, হিসাবি, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন হন না কেন, বসন্তের এ দিনে তারা গেয়ে উঠবেন ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে...।’ যেন তাদের ‘হারিয়ে যেতে আজ নেই মানা।’

‘বাসন্তী তরুণী’রা খোঁপায় গাঁদা, পলাশসহ নানা ফুল গুঁজে আর ‘বসন্ত তরুণ’রা পাঞ্জাবি ও ফতুয়ায় নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নেমে আসবে পথে পথে। মোবাইল ফোনে এসএমএস আদান-প্রদান, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে ঋতুরাজ বসন্তকে।

বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। ‘ছায়ানট’ বসন্ত উৎসব শুরু করে ১৯৬২ সালে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।

গ্রামেও এখন ফাগুনের ছোঁয়া। গাঁয়ের বধূরা আজ আঙিনা লেপে বরণ করে নেবে ফাগুনকে। তুলে রাখা হলদে শাড়িও বের করবে আজ। শুরু হবে বোরো চারা রোপণের পালা। মাঘের শীতে আবাদের মাঠে যেতে পারেননি কৃষক। ফাগুনের দিনে তারা স্বাচ্ছন্দ্যেই যেতে পারবেন। বসন্ত সবার হূদয়ে এনে দেয় ফাগুনের দোলা।

সরগরম ফুলের বাজার : বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সরগরম হয়ে উঠেছে ফুলের বাজার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানী, ধানমন্ডি ও শাহবাগের বিভিন্ন ফুলের দোকানে ক্রেতাদের আগমনে জমে উঠে বেচাকেনা।

এবারের বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় সব ধরনের ফুলের দাম কয়েকগুণ বেশি। দাম বেশি হলেও বসন্ত বরণের উৎসব এবং ভালোবাসার কাছে যে বাড়তি দাম কোনো বিষয়ই নয়, তারই প্রমাণ মেলে এ ভিড়ে।

রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফুলের দামের ভিন্নতাও দেখা গেছে। ধানমন্ডিতে যে দেশি গোলাপ ৩০ টাকা, সেটি শাহবাগে বিক্রি হয় ২০ টাকায়। ধানমন্ডিতে চায়না গোলাপ (দেশে উৎপাদিত) ৬০ টাকায় বিক্রি হয়, যা শাহবাগে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্য ফুলের ক্ষেত্রেও দামের পার্থক্য রয়েছে।

শাহবাগের ফুলতলা ফ্লাওয়ার শপের আনোয়ার হোসেন বলেন, বেচাকেনা ভালোই হচ্ছে। এবার ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত উৎসব একই দিনে এবং ছুটির দিন পড়েছে, তাই বিকেল থেকে বেচাকেনা আরো বাড়বে আশা করা যাচ্ছে।

রাজধানীর একাধিক ফুলের দোকানদার জানান, ফুলের চাহিদা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। ফুলের বেচাকেনাও জমে উঠেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনা আরো বাড়বে।

সদ্য বিবাহিত কামরুল হাসান সবুজ সস্ত্রীক শাহবাগে এসেছেন ফুল কিনতে। এ নবদম্পতি জানান, বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং শুক্রবার বইমেলা উপলক্ষে প্রচণ্ড ভিড় হবে, তাই একদিন আগেই ফুল কিনতে এসেছি। ফুলের দাম প্রসঙ্গে তারা বলেন, ভালোবাসা দিবসে ফুলের দাম প্রতিবছর বেশিই থাকে। বেশি দাম দিয়েই কিনতে হলো। কিছুই করার নেই উৎসব তো পালন করতেই হবে।

কর্মসূচি : নাচ, গান ও কবিতাসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বসন্ত বরণ করবে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ। এ ছাড়া আজ রাজধানীতে রয়েছে ব্যাপক আয়োজন। চারটি স্থানে আয়োজন করা হয়েছে ‘বসন্ত উৎসব’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় দিনব্যাপী এবং ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক ও উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে বিকেল থেকে রাত অবধি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।

শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে তিন দিনব্যাপী ‘বসন্ত উৎসব’। একাডেমি প্রাঙ্গণে নন্দনমঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় থাকবে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads