• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

‘মুর্তজা বশীরের সৃষ্টি ও প্রসারিত মন’

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর ২০২০

মুর্তজা বশীর ছিলেন বাংলাদেশের একজন মেধাবী এবং শক্তিমান চিত্রশিল্পী। দেশভাগের পরপরই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ মিলে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা সামনে রেখে চারুকলা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই সময় দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন মুর্তজা বশীর। সেই সময় শিল্পীদের জীবন ছিল একেবারে দুঃখে ভরা, হতাশায় ভারাক্রান্ত। শিল্পীদের পেশা, তাদের সামাজিক অবস্থান- সবকিছুই যেন অবহেলিত। সেই সময়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে একজন শিল্পানুরাগী ছাত্র মুর্তজা বশীর আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছেন, এ ব্যাপারটা এখনকার দিনে কল্পনা করা অনেকটাই কঠিন।

বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতে মুর্তজা বশীর একটি অনন্য নাম হলেও চিত্রকর্মেই তার সাধনা আটকে থাকেনি। তিনি ছিলেন বহুমুখী সৃজন-প্রতিভার অধিকারী। তিনি সুলেখক, শিক্ষক ও প্রত্নগবেষক। তার আরো একটি বিস্মৃতপ্রায় পরিচয়- তিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালকও। ষাটের দশকে ‘কারওয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন মুর্তজা বশীর। চিত্রকলায় সর্বাধিক সুনাম অর্জন করলেও শিক্ষকতা, লেখালেখি ও গবেষণাতেও তিনি যথেষ্ট সফল। একাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের লেখক তিনি। ‘হেরিটেজ অব বেঙ্গল’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। কাজ করেছেন পশ্চিম বাংলার মন্দিরের টেরাকোটা শিল্প নিয়ে, প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। মূলত সমস্ত জীবনে তিনি নানা কাজের মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্য খুঁজেছেন, সন্ধান করেছেন জীবনের নানা অর্থ।

শিল্পীর চিরবিদায়ের মাত্র মাসাধিককালের মধ্যেই তার জীবনের বিচিত্রবিধ সৃষ্টিকে এক গ্যালারিতে তুলে এনেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের অন্যতম এই পুরোধা শিল্পীর বহুমাত্রিক কাজ নিয়ে গত ১২ অক্টোবর ‘মুর্তজা বশীরের সৃষ্টি ও প্রসারিত মন’ শীর্ষক তিন মাসব্যাপী এ প্রদর্শনীর অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ধানমন্ডিস্থ বেঙ্গল শিল্পালয়ে। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে এটিই প্রথম প্রদর্শনী। করোনা মহামারী বিঘ্নিত এ সময়ে সচরাচরের মতো আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে শুরু না হলেও আয়োজনে ও কলেবরে দারুণভাবে বিস্তৃত এ প্রদর্শনী। বেঙ্গল শিল্পালয় কর্তৃপক্ষের যথাবিহিত স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থায় শিল্পানুরাগীরা ইতোমধ্যে তাদের প্রিয় শিল্পীর কাজ দেখতে আসছেন নিয়মিত। আট থেকে দশজনের একটি দল দর্শনার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক কাজ করছেন গ্যালারিতে।

এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে শিল্পীর জীবনের প্রায় সত্তর বছরের শিল্পসাধনার অনন্য নিদর্শনগুলো। জীবনের বিভিন্ন সময়ে শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম, ছাপচিত্রের পাশাপাশি চিঠিপত্র, স্কেচ, আলোকচিত্র, পেপারকাটিং রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। স্থান পেয়েছে মুর্তজা বশীরের নিজের লেখা বই এবং তাকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ-সংকলন। ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত-সংগ্রহ থেকে সংগৃহীত হয়েছে প্রদর্শনীর এ কাজগুলো। যার মধ্যে রয়েছে মুর্তজা বশীরের বেশ কিছু বিরল চিত্রকর্মও।

জীবনের বিভিন্ন সময়ে মুর্তজা বশীর বেশ কিছু চিত্রমালা বা সিরিজ অঙ্কন করেছেন, যার অধিকাংশই শিল্পজগতে সুনাম কুড়িয়েছে। বৈচিত্র্যপিয়াসী সৃজনশৈলীর পাশাপাশি ধারাবাহিক চিত্রমালা সৃষ্টি ছিল তার কাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। একটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর ধারাবাহিক ছবি নির্মাণের এ চর্চায় শিল্পী এঁকেছেন ‘দেয়াল’, ‘প্রজাপতি’, ‘এপিটাফ’, ‘ইমেজ’, ‘আলো’, ‘পাখা’ ইত্যাদি নামের সিরিজ। তার এ ধারাবাহিক চিত্রমালায় একই বিষয়ের ওপর বহুমুখী ভাবনার প্রতিফলন বা একটি বিষয়কে নানাভাবে দেখবার প্রবণতা সুস্পষ্ট। এর সঙ্গে রয়েছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ ও নারীকে উপজীব্য করে আঁকা ছবিসমূহ : ‘তোতা হাতে মেয়ে’, ‘দুপুরে শায়িত মেয়ে’, ‘শাদাবাড়ির মেয়ে’, ‘ফুল হাতে মেয়ে’, ‘মেয়ে হাসছে’ ইত্যাদি। বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে মুর্তজা বশীর করেছেন উডকাট।

প্রদর্শনীর শুরুতেই দেখা যাবে শিল্পীর ‘প্রজাপতি’ চিত্রমালার অনেকগুলো কাজ। শিল্পীর বিখ্যাত ‘দেয়াল’ সিরিজের কাজ রয়েছে প্রদর্শনীতে, স্থান পেয়েছে ‘কালেমা তৈয়বা’ সিরিজের একটি কাজ, ‘জ্যোতি’ সিরিজের দুটি কাজ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে মুর্তজা বশীরের একমাত্র উডকাট ‘রক্তাক্ত একুশ’, যার শিল্পীর হাতের স্বাক্ষর করা একটি মূল ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সৌজন্যে। প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম ও বিবিধ প্রকাশনার ১৬ জন সরবরাহকারীর মধ্যে তিনিও একজন। ‘রক্তাক্ত একুশ’-এর একটি পুনর্নির্মাণ স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। বাংলার মন্দির-মসজিদে পোড়ামাটির কাজ নিয়ে মুর্তজা বশীর বহুদিন ধরে গবেষণা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০০টি গ্রাম ঘুরে তিনি সেখানকার শিল্পকলা, বিশেষ করে পোড়ামাটির শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার সময় অনেক আলোকচিত্র তুলেছিলেন নিজের ক্যামেরায়। সেসবের বিশেষ কিছু আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। গ্যালারির একটি দেয়ালজুড়ে ৪৯টি আলোকচিত্র দেখতে পাবেন দর্শক। সেখানে শিল্পীর নিজের তোলা ছবি যেমন আছে, তেমনি অন্যদের তোলা শিল্পীর সেই গবেষণা অভিযানের কিছু ছবিও আছে।

মুর্তজা বশীর রচিত বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দেখা যাবে এ প্রদর্শনীতে। তা ছাড়া রয়েছে শিল্পীকে নিয়ে লেখা বিশিষ্টজনের রচিত বেশ কিছু প্রকাশনাও। মুনতাসীর মামুনেরই সংগ্রহ থেকে মুর্তজা বশীরের আত্ম-প্রতিকৃতির একটি অ্যালবাম রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে।

বিবিধ সৃজন সাধনার পাশাপাশি শিল্পীর বিচিত্র কিছু শখ ছিল। তেমনই একটি দিয়াশলাই বাক্স দিয়ে বিভিন্ন রকম স্মারক তৈরি। সে রকম পাঁচটি স্মারক আছে প্রদর্শনীতে। মুনতাসীর মামুনের সরবরাহ করা মুর্তজা বশীরের সংগৃহীত কিছু মুদ্রাও স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে।

বেঙ্গল শিল্পালয় আয়োজিত এবারের প্রদর্শনীতে একটি নতুন সংযোজন হলো, প্রদর্শিত শিল্পীর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সে কাজের সংশ্লিষ্ট কিছু আলাপের অডিও সুবিধা। যার মাধ্যমে দর্শকরা গ্যালারিতে যে কাজটি দেখছেন, তার সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনা পেয়ে যাবেন। এ অডিওগুলো আলাদা আলাদা কিউআর কোডের মাধ্যমে দর্শকরা নিজ নিজ মোবাইল ফোনেই শুনতে পাবেন। এবারের প্রদর্শনীতে এ পর্যন্ত সাতটি কিউআর কোড তৈরি করা হয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই প্রদর্শনীতে যুক্ত হবে মুর্তজা বশীরের বিবিধ শিল্পসৃষ্টি ও শিল্পীসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads