• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ডিলিট বিশ্ব বাঙালিকে উৎসর্গ শেখ হাসিনার

ডিলিট বিশ্ব বাঙালিকে উৎসর্গ শেখ হাসিনার

সংগৃহীত ছবি

সরকার

ডিলিট বিশ্ব বাঙালিকে উৎসর্গ শেখ হাসিনার

  • ঈশিকা অথৈ, আসানসোল
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৮

ভারতের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার (ডিলিট)’ ডিগ্রি বিশ্ব বাঙালিকে উৎসর্গ করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার সাড়ম্বর এক আয়োজনে তাকে এই সম্মাননা প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. সাধন চক্রবর্তী। সম্মাননা পেয়েই তা গোটা বাঙালি জাতিকে উৎসর্গ করেন শেখ হাসিনা।  

আসানসোলের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ও সম্মানসূচক ডিলিট প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্ববিদ্যালয়টির সব অনুষদের প্রধান। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টজনরা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের সবাই। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক্ষার্থীকে স্বর্ণপদক ও ৪৪০ জনকে সনদ দেওয়া হয়। 

স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় সমাবর্তন সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির তৃতীয় ও বিশেষ এই সমাবর্তন শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে সংক্ষিপ্তভাবে ১০ জনকে স্বর্ণ পদক তুলে দেন উপাচার্য। তার পর পরই শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন সম্মানসূচক ডিলিট প্রদান অনুষ্ঠান। মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপাচার্য সাধন চক্রবর্তী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কবি নজরুলের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি প্রদান করল- সে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এবং গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য সম্মান জানানো হলো শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই সম্মান দিতে পেরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষও গর্ববোধ করবে। এর পরই শেখ হাসিনাকে মঞ্চে ডেকে নেন উপাচার্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ডিলিট ডিগ্রি গ্রহণের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আবেগ আপ্লুুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান ও তার নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তারই জন্মদিনের দিন এই উপাধি আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। এই সম্মান উৎসর্গ করলাম বাংলাদেশের মানুষকে, সমস্ত বাঙালিকে। ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কিন্তু ভাগ হয়নি। তাই এখানে এলাম। এ সম্মান শুধু আমার নয়, গোটা বাংলাদেশের মানুষের’।

শেখ হাসিনা তার ২৭ মিনিটের বক্তব্যে সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আর সব ভাগ হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিন্তু ভাগ হয়নি। নজরুল ইসলাম সম্প্রীতির প্রতীক। মানবতার জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার আন্দোলন ছিল মানুষের অধিকারের জন্য।’ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমি সমস্ত ভারতবাসীকে সম্মান জানাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছিলাম। সেই দেশ গড়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের জন্যই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশ গড়া সম্ভব হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তখন আমি আর আমার বোন বিদেশে ছিলাম। সেই বিধ্বস্ত অবস্থায়ও ভারতবাসীকে পাশে পেয়েছিলাম।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চুরুলিয়ায় যখন এসেছিলাম, তখন খুব করুণ অবস্থা ছিল। ধন্যবাদ জানাই মুখ্যমন্ত্রীকে, যিনি নজরুলের জন্য অনেক কিছু করেছেন।’

আসনসোলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দিলেন। শেখ হাসিনা ১৯ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর আমলে নজরুল জন্মশতবর্ষ উৎসবে যোগ দিতে বর্ধমানের আসানসোলের চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নজরুল আমাদের চেতনায় সোনার ফসল ফলিয়ে গেছেন। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কবি নজরুল। ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, লেখক, নাট্যকার, গীতিকার, আবৃত্তিকার, সাংবাদিক, সৈনিক, সঙ্গীতশিল্পীসহ আরো কত কী?’ তিনি বলেন, ‘তাই এত বড় এক প্রতিভাধরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি।’ মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নজরুলের কবিতা থেকে নেওয়ার কথাও বলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর তরুণ বয়সে নজরুলের সঙ্গে পরিচয় এবং নজরুল সাহিত্য দ্বারা বঙ্গবন্ধুর উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একজন ছিলেন সাহিত্যের কবি, আর অন্যজন ছিলেন রাজনীতির কবি। দুজনই অসাম্প্রদায়িক ও শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। কবি নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন। সেই চেতনায় আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি।

শেখ হাসিনা সমাবর্তনে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, হামদ-নাতের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম এবং শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন বৈষ্ণব গীতি রচনা করে হিন্দু ধর্মের মানুষের কাছে যাওয়ার বিরল প্রতিভা কবি নজরুলের ছিল। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চিরজীবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাব।

সকালে কলকাতা থেকে বিমানে দুর্গাপুরের কাজী নজরুল বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখান থেকে সড়কপথে দুপুরে আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান উপাচার্য সাধন চক্রবর্তী। এরপর শুরু হয় বিশেষ সমাবর্তন ও ডি-লিট প্রদান অনুষ্ঠান। আসানসোল থেকে কলকাতায় ফিরে নেতাজি জাদুঘর পরিদর্শন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর শনিবার রাতেই ঢাকা ফেরার কথা শেখ হাসিনার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেওয়া হয় গোটা আসানসোল শহর। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর অনুষ্ঠান শুরু হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, চুরুলিয়ায় জন্ম হলেও কবি নজরুলের বিচরণ ছিল সারা বাংলায়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তার চিকিৎসা ও বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করেন। নজরুলের বিখ্যাত গান ‘চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কবির মৃত্যুর পরে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদিনের সফরে গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গে যান। সেখানে তিনি বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে যোগ দেন। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থানুকূল্যে নির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। বিকালে কলকাতায় ফিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি পরিদর্শন করেন, হোটেল তাজ বেঙ্গলে কলকাতার ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং রাতে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নরের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads