• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ছবি : সংগৃহীত

সরকার

বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন

# দুর্নীতি, মাদক, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড বেকায়দায় ফেলছে সরকারকে # পরিস্থিতি উত্তরণে সচেষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এই মুহূর্তে শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল নেই রাজনীতির মাঠে। নেই জঙ্গি তৎপরতা। এ বিবেচনায় নির্বিঘ্ন ও আয়েসে সরকার পরিচালনার সুযোগ থাকার কথা টানা তৃতীয়বার ও মোট চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই প্রতিকূল। জঙ্গি দমন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সফল হলেও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, মাদকের ভয়াবহতা, অনিয়ন্ত্রিত সড়কে প্রতিদিন প্রাণহানি, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা নেতিবাচক উপসর্গ বেকায়দায় ফেলছে সরকারকে। এছাড়াও রয়েছে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের আন্দোলনের হুমকি। এসব মোকাবেলা করে পরিস্থিতি অনুকূলে রেখে সুশাসন বজায় রাখাই এখন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি উত্তরণ করে সুশাসন নিশ্চিত করতে যারপরনাই চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সূত্র জানায়, জঙ্গিবাদ বাংলাদেশেও জেঁকে বসেছিল। মূলত ১৯৯০-এর শুরুর দিকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হলেও উত্থান হয় ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সময়ে। এ সময় জেএমবি নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর নেতৃত্ব দেন শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই। ওই সময় দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়। এই ঘটনা ছাড়াও ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সময়ে যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাটের চার্চ, খুলনা, পল্টনে সিপিবির অনুষ্ঠান, ময়মনসিংহ ও যশোরের ৪টি সিনেমা হলে, ঝালকাঠিতে বিচারক ও সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে বোমচার্জে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ অবস্থায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নড়ে চড়ে বসে সরকার। সরকারের প্রশাসনযত্র জঙ্গি উৎখাতের মিশন নিয়ে মাঠে নামে। দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী ড্রাস্টিক অভিযান শুরু করে সমন্বিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। একে একে ধরা পড়ে শীর্ষ জঙ্গিরা। ২০০৭ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে উত্থিত জঙ্গিদের অনেকটাই পতন হয়। সরকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু ২০০৭ থেকে ১৩ পর্যন্ত সময়ে জঙ্গিরা প্রথম দিকে ঘাপটি মেরে থেকে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হতে থাকে। ২০১৪ সালে আরনসারুল্লাহ বাংলাটিমের ব্যানারে জঙ্গিরা ব্লগার হত্যা শুরু করে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে তারা আবারও শক্ত অবস্থান জানান দেয়। এবার সরকার আঁঁটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। ২০১৬-এর জুলাই থেকে ১৮-এর জুলাই পর্যন্ত এই ২ বছরে সরকারের সফল অভিযানে অর্ধশত শীর্ষ জঙ্গি নিহত হয়- গ্রেফতার হয় আরো ৫ শতাধিক। জঙ্গি দমনে সরকারের ভূমিকা প্রশংসিত হয় বহির্বিশ্বেও।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচেনর আগে ও পরে বিরোধী দলের অগ্নি সন্ত্রাসসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ সরকার। এর ধারাবাহিকতায় গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ। পক্ষান্তরে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি দিন দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বিএনপির এই নাজুক অবস্থায় রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগ এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, কি সরকারে-কি রাজপথে। সরকারের কোনো সমালোচনা বা সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি দেওয়ার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে বিএনপি। এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার মতো কোনো বিরোধী দল নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুশাসনের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা আর প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া দুর্নীতি নামের কীট।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুর্নীতি শামাল দিতে না পারলে মাশুল দিতে হবে সরকারকে। সমাজের উঁচু থেকে নিম্নবিত্ত-সর্বস্তরে দুর্নীতির ভূত চেপে বসেছে। যে যেখানে পারছে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়-অনিয়মে যুক্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এ কারণে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারীর সাজা ভোগ করতে হচ্ছে জাহালমের মতো নিরীহ শ্রমিককে। আর অন্যের দুর্নীতি ধরার দায়িত্বপ্রাপ্তরা উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সস্তা বাহবা কুড়ানোর ধান্ধা করছে।

এদিকে, সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে না, এটা অনিবার্য হওয়ার পরও দৃশ্যত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের দিক থেকে। সরকারের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই এই সেক্টরে। গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটি পুরোটাই এখন মাফিয়াদের দখলে। আবার সেই মাফিয়ারাই ঘাপটি মেরে আছে সরকারে, আছে নীতিনির্ধারকের আসনেও। সরকারের বিনিয়োগ না থাকলে এই সেক্টরের কোনো উন্নতি হবে না এবং সে ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনাও হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার এ ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

অন্যদিকে, মাদক নির্মূলে সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেটা পরিকল্পিত না হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ছে মাদকবিরোধী জিরো টলারেন্স মিশন। বিগত দিনের অভিযানগুলোতে এ অপরাধ জগতের কিছু চুনোপুঁটিকে ধরা হলেও গড ফাদাররা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই। তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে, মাদকের উৎস বন্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেই।  অভিযান শুধু কিছু ক্যারিয়ার আর চুনোপুঁটি ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে  কোনো সুফল আসবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়াচক্রের সদস্যরা বাংলাদেশকে মাদকের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তারাই দেশের বাইরে অবস্থান করে ইয়াবার মতো মরণ নেশাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটা বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী ড্রাইভ দিতে হবে।

তিনি বলেন, সীমান্তে আরো কড়াকড়ি করার পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের জানান দিতে হবে, তোমার দেশ থেকে এসব পাচার হচ্ছে এসব বন্ধ কর। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইয়াবার কারখানাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানাতে হবে মৌখিক এবং লিখিতভাবে। সেটা তারা আমলে না নিলে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে চাপ দিতে হবে।

মাদক ছাড়াও ইদানীং আগুনের লেলিহান শিখা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সরকার। রাজধানীসহ প্রতিনিধি দেশের কোথাও না কোথাও ছোটবড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একের পর এক উত্তপ্ত হচ্ছে কোনো না কোনো ইস্যুতে, যা বারবার অস্বস্তিতে ফেলছে সরকারকে।

অন্যদিকে বিভিন্ন সময় নানা পেশাজীবী সংগঠন প্রায়ই সচিবালয়ের আশপাশ, শহিদ মিনার ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামেন অনশন করছে। সরকার কিছুদিন দেখার পর অপ্রতিরোধ্য এসব আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফেরাচ্ছে। কিন্তু আশ্বাস বাস্তাবায়ন না হওয়ায় তারা আবার আসছে, আবার মাঠে নামছে আন্দোলন নিয়ে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি বা সঙ্কট না থাকলেও আয়েসে বা নির্বিঘ্নে চলার সুযোগ নেই সরকারের। দুর্নীতি, মাদক, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা সংগঠনের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত আন্দোলন মোকাবেলা করে এখন সুশাসন বজায় রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের জন্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads