• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আসামের এনআরসি’র দিকে সরকারের নজর

ছবি : সংগৃহীত

সরকার

আসামের এনআরসি’র দিকে সরকারের নজর

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ভারতের আসাম রাজ্যে বিতর্কিত চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) প্রকাশের বিষয়গুলোর দিকে গভীর নজর রাখছে বাংলাদেশ। এনআরসি ইস্যু বাংলাদেশের জন্য কী অর্থ বহন করছে, বিষয়গুলোতে এ দেশের জন্য উদ্বেগের কোনো কারণ আছে কি না এবং এর প্রভাব দেশে কেমন হতে পারে ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেসব দিকে নজর রাখছে সরকার। এনআরসি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে দেশটির সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বাংলাদেশকে একাধিকবার আশ্বস্ত করা হলেও ভবিষ্যতে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে দেশটিতে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি কোন দিকে গড়ায়, এসব দিকও সরকারের অনেকের ভাবনায় আছে।

সূত্র জানায়, ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে এবং তালিকায় নাম না থাকা ‘অবৈধ মুসলমান অভিবাসীরা বাংলাদেশের’ দাবি করায় বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি না সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। তালিকায় বাদপড়া অভিবাসীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে বিজেপি সরকারের বেশ কয়েকজন অতীতে নানা সময়ে ঘোষণা দিয়েছেন। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরে ‘অভিবাসী’ রাজনীতি কোন দিকে গড়ায়, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল শনিবার সরকারের কেউ কোনো কথা না বললেও দেশের জনগণ ও বিশেষ করে ধর্মপন্থি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেদিকেও গভীর দৃষ্টি রাখছে সরকার।

নীতিনির্ধারণী সূত্রমতে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি ঢাকা সফরে এলে বাংলাদেশকে আশ্বাস্ত করেন, এনআরসি ভারতের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির আইনজ্ঞ সেলের সদস্য ও দলের নেতা বিবেক রেড্ডি গতকাল সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে এস জয় জয়শঙ্কর এনআরসি নিয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটাই শেষ কথা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে অনেক কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

এনআরসি প্রকাশের ঘটনায় বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও গতকাল তা প্রকাশের পর সীমান্তে জারি করা হয় সতর্কতা। দেশের সীমান্ত এলাকা, বিশেষ করে সিলেট সীমান্তে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে’ (বিজেবি) সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। যাদের আসামের নাগরিক তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে, তাদের যাতে ভারত কোনোভাবে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ে প্রথমে আসামের অস্বাভাবিক নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে কোনো বার্তা আদান-প্রদান হয়নি। শুরুতে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। পরে ভারতীয় সরকারপ্রধান নিজেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেন যে, খসড়া তালিকা থেকে বাদপড়া আসামের জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা ভাবছে না ভারত। ভারতের এ কথায় আশ্বস্ত হওয়ায় বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে কেউ এনআরসির চূড়ান্ত তালিকার বিষয়ে আপাতত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভাজন এবং এর থেকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ শুধু ভারতের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। এতসংখ্যক মানুষকে একসঙ্গে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিতকরণের প্রক্রিয়াটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে বাংলাদেশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এ প্রসঙ্গে চুপ করে থাকা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হতে পারে। কারো কারো মতে, এনআরসির তালিকা প্রকাশের পরও ‘নাগরিকত্ব’ প্রমাণের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়। বিজেপি সরকারের কেউ কেউ চাইলেই এত মানুষকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারবে না ‘নাগরিকত্ব’ প্রমাণের লম্বা আইনি প্রক্রিয়া থাকায়।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি হবে। এ বিষয়ে ট্রাইবুন্যালে আপিল করা যাবে। হাইকোর্টে যাওয়া যাবে। তবে কতজনের সেটা করার আর্থিক সক্ষমতা আছে, তা দেখার বিষয়। ভারত বলছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সরকারও এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছে। যতদিন এটা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি না করছে, ততদিন এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।’

সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কেউ কেউ মনে করেন, আসামে কথিত নাগরিক তালিকা প্রকাশের ঘটনায় এ দেশের মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানুষ প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে। এরই মধ্যে নানা মাধ্যমে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তবে এর বড় কোনো প্রভাব দেশে পড়বে বলে মনে করেন না তারা। তাদের মতে, টুকটাক প্রতিক্রিয়া হবে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। ধর্মপন্থি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাতে পারে। এ বিষয়ে সরকার সতর্ক আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সতর্ক অবস্থানে আছে।

উল্লেখ্য, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশিত হয় গতকাল স্থানীয় সময় সকাল দশটায়। অনলাইনে ও এনআরসি সেবাকেন্দ্রে প্রকাশিত এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন দেশটির ১৯ লাখ ছয় হাজার বাসিন্দা। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানায়, চূড়ান্ত এনআরসি থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তারা ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাদ পড়া বাসিন্দারা ‘বিদেশি’ হিসেব চিহ্নিত হবেন না। তবে এ আপিলে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানায় দেশটির গণমাধ্যমগুলো। বাদ পড়াদের মধ্যে অধিকাংশই নিম্ন আয়ের হওয়ায় তারা এ খরচ বহন করতে পারবেন না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এনআরসিতে যারা নাগরিকত্বহীন বলে ঘোষিত হয়েছে, তাদের প্রতিটি পরিবারে ইতোমধ্যে মানবিক বিপর্যয়কর এক অবস্থা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads