• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ময়ূর, ফুল, প্রকৃতি নানা রঙে বিরাজ করে সাঁওতাল গৃহের দেয়ালে দেয়ালে

বাংলাদেশের খবর

জীবন ধারা

সাঁওতাল গৃহে খেলা করে সাত রঙ

  • প্রকাশিত ০৪ এপ্রিল ২০১৮

মাটির ঘরে বাস করে সাঁওতালরা। ঘরটি মাটির হলেও এর আবেদন অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এই আবেদনের মূলে আছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, রঙের কারুকাজ। একটি সাঁওতাল বাড়ির গোয়ালঘর থেকে শুরু করে শোয়ার ঘর পর্যন্ত সর্বত্র চোখে পড়ে রঙের ছড়াছড়ি, আঁকাআঁকি। নকশিকাঁথায় যেমন গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয়। সাঁওতালরাও তাদের ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকে ময়ূর, ফুল, পাখি। ক’দিন আগেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি সাঁওতালপাড়ায় এসব আঁকাআঁকিতে চোখ আটকে গিয়েছিল আলোকচিত্রী প্রণব ঘোষের। স্বভাবতই একটি সাঁওতাল বাড়ির অন্দরমহলের চালচিত্র ক্যামেরায় বন্দি করতে দেরি করেননি তিনি।

বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই এই ব-দ্বীপে তাদের বসবাস। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলেই মূলত তাদের কোণঠাসা অবস্থান। এ অবস্থায়ই তারা তাদের শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে আছে। দেশে অবস্থান করা অন্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সাঁওতালরা। বাড়ির অন্দর রঙিন করে তোলা তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আলোকচিত্রী প্রণব জানান, যে উপায়ে তারা তাদের ঘরগুলোকে রঙিন করে তোলে তা সত্যিই অসাধারণ এবং নজরকাড়া। সাঁওতালদের মধ্যে দুটি শ্রেণি রয়েছে। তাদের একটি অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আরেকটি ক্যাথলিক খ্রিস্টান। দিওয়ালি উৎসবকে সামনে রেখে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাঁওতালরা তাদের বাড়ি রঙিন করে তোলে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সাঁওতালরা এটি করে তাদের উৎসবকে কেন্দ্র করে।

বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে সাঁওতাল সম্প্রদায় দারুণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয়। নেহাত মাটি দিয়ে তারা এমনভাবেই তাদের ঘরটিকে তৈরি করে যে, এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকে।

সাঁওতালদের উৎসবগুলোও দারুণ প্রাণবন্ত। সোহরাই, বন্দনা, খ্রিসমাস ইত্যাদি হলো তাদের উল্লেখযোগ্য উৎসব। তবে সব উৎসবকেই ছাড়িয়ে যায় সাঁওতাল বিয়ে। আর সাঁওতাল বিয়ে মানেই রঙের ছড়াছড়ি। কোনো বাড়িতে বিয়ের উপলক্ষ হাজির হলেই তারা নতুন করে রাঙাতে শুরু করে বাড়িটির ভেতর-বাহির। এ ছাড়া অন্য উৎসবগুলোয় তারা তাদের বাড়ি রঙ করে।

প্রণব বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায় আসলে সবচেয়ে রঙিন। রাষ্ট্রের উচিত কোনোক্রমে টিকে থাকা সাঁওতালদের ব্যতিক্রম ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করা। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তারা। দিন দিন বিলুপ্তির পথে হাঁটছে সম্প্রদায়টি। যদি এমনটি চলতেই থাকে তবে এই সম্প্রদায়ের রঙিন মানুষগুলোকে জানতে ব্যর্থ হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।’

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সাঁওতালরা পূর্ব ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় আদিবাসী গোষ্ঠী। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, রাজশাহী, দিনাজপুর অঞ্চলে তারা অতি প্রাচীনকাল থেকেই বসবাস করছে। মোট ১২টি গোত্রে বিভক্ত সাঁওতালরা। তাদের ভাষায় এ গোত্রগুলো ‘পারিস’ নামে অভিহিত। যেমন- হাঁসদা, সরেন, টুডু, কিসকু, মুর্মু, মার্ড়ী, বাস্কে ইত্যাদি।

অভিযোগ আছে, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এদেশীয় সাঁওতালরা নানা শোষণ, বৈষম্য, প্রান্তিকতা, অতিদরিদ্রতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শিকার হয়েছে। অনেক আদিবাসী তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে। অথচ ব্রিটিশবিরোধী তেভাগা আন্দোলনে তারা গর্জে উঠেছিল, ‘জান দেব, তবু ধান দেব না’। সেই ভূমি বাঁচানো জনগোষ্ঠীই আজ কোনো রকমে টিকে থাকার লড়াই করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads