• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ব্যবসায়ীরা অনড় সরকারও কঠোর

ব্যবসায়ীরা অনড় সরকারও কঠোর

ছবি : সংগৃহীত

মহানগর

ব্যবসায়ীরা অনড় সরকারও কঠোর

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৪ মার্চ ২০১৯

পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম না সরাতে অনড় ব্যবসায়ীরা। ফলে রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে সরকারি টাস্কফোর্স। তবে সরকারও এ বিষয়ে কঠোর। ব্যবসায়ীদের সব বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে রাসায়নিক দোকান ও গুদাম উচ্ছেদে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স।

গতকাল রোববার অভিযানের তৃতীয় দিনেও বাধার মুখে পড়েছে অবৈধ রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কারখানা অপসারণে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা টাস্কফোর্স সদস্যদের দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে লালবাগ থানার পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এ সময় বিদ্যুতের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রোববার দুপুর ১২টার দিকে লালবাগের রাজনারায়ণ রোডে ২/৩ হোল্ডিং নম্বরে অভিযান চালিয়ে অবৈধ প্লাস্টিকের চারটি টিন শেড কারখানা, একটি পাঁচতলা ভবনে রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কারখানার সন্ধান পায় টাস্কফোর্স টিম-২ দল। এ সময় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে ঢাকা জেলা পরিষদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুবর্ণা শিরীন ও সিটি করপোরেশন প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হাসানসহ টাস্কফোর্স-২-এর সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সরাতে মৃদু লাঠিচার্জ করে পুলিশ। রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা উচ্ছেদ অভিযানকে ঘিরে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরে লালবাগ থানা পুলিশের সহায়তায় আবার অভিযান শুরু করে টাস্কফোর্স।

সকাল ১১টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) টাস্কফোর্সের একটি দল পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় অভিযান চালায়। ওই এলাকার আজগর লেন, নন্দ কুমার দত্ত লেন ও হায়দার বক্স লেনের ছয়টি ভবনের নিচে গুদামে তল্লাশি চালায়। তিনটি গুদামে প্লাস্টিক দানা পাওয়া যায়। এরমধ্যে তিনটি গুদামের পরিবেশ ও ব্যবসার লাইসেন্স না থাকায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে টাস্কফোর্স। বাকি তিনটি গুদামে প্লাস্টিক দানা ও কেমিক্যাল না থাকায় আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই এলাকায়ও অভিযান চলাকালে স্থানীয় ও ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়ে টাস্কফোর্সের টিম। এক পর্যায়ে স্লোগান দিয়ে অভিযানের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন।

বিক্ষোভকারীরা বলেন, প্লাস্টিকে আগুন ছড়ায় না, এটি ক্ষতিকর নয়। পুরান ঢাকার যেসব জায়গায় দাহ্য কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্লাস্টিকের গুদামে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া মালামাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হচ্ছে না।

ব্যবসায়ী আফসার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের অন্তত ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় দেওয়া উচিত। আমাদের ব্যাংক লোন রয়েছে। শত শত শ্রমিক রয়েছে, তারা না খেয়ে মরবে।

অভিযান চলাকালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাসহ বিস্ফোরক অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, ঢাকা জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ঢাকা ওয়াসা ও ডিপিডিসি, চকবাজার থানা পুলিশের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

গত শনিবারও পুরান ঢাকার বকশীবাজারের জয়নাগ রোডে নিষিদ্ধ রাসায়নিক গুদাম, পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে টাস্কফোর্সের সদস্যরা। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের হস্তক্ষেপে আবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে রাসায়নিক গুদাম, পলিথিন, প্লাস্টিকসহ মোট ১৩টি কারখানার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

টাস্কফোর্সের টিম-২-এর নেতৃত্বে থাকা ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনালের শরীফ আহমেদ খান বলেন, তৃতীয় দিনের মতো আমরা চকবাজারের ৬টি হোল্ডিংয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। এরমধ্যে দুটি হোল্ডিংয়ের গুদামে কাচের চুড়ি এবং বাচ্চাদের খেলনা ছিল যা আমাদের অভিযানের মধ্যে পড়ে না। তাই এই দুটি হোল্ডিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আর একটি হোল্ডিংয়ের গোডাউনে থেকে মালিক মালামাল সরিয়ে ফেলায় আমরা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। বাকি তিন হোল্ডিংয়ের ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি হোল্ডিংয়ে আমরা প্লাস্টিক গুদামের সন্ধান পেয়েছি। তাই এই তিনটি গুদামের ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। শুধু গুদামগুলোর ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, বাসাবাড়ির নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের অভিযান চলছে, আগামীতেও চলবে। আমাদের মেয়র সাহেব অভিযান সম্পর্কে শনিবার সবাইকে পরিষ্কারভাবে বলছেন। আমাদের অভিযান বাসাবাড়ির বিরুদ্ধে নয়। আমাদের অভিযান অবৈধ কেমিক্যাল এবং প্লাস্টিক গুদাম ও কারখানার বিরুদ্ধে।

ব্যবসায়ীদের কোনো বাধায় পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ কার্যক্রম থেকে সরকার সরে আসবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ে নিরাপত্তা সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, যত বাধাই আসুক জনস্বার্থে রাজধানীর চকবাজারে রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান ও গুদাম উচ্ছেদে অভিযান চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে সিরিয়াস। তিনি একটি দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র যে সহযোগিতা চাইবেন সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হবে। এখানে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

উচ্ছেদ অভিযানে ব্যবসায়ীরা বাধা দেন। এভাবে বাধাগ্রস্ত হলে সরকার দমে যাবে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দমে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। যেখানে এত মানুষ হতাহত হচ্ছে জনস্বার্থে দমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, নিমতলীর ঘটনার পরই আমরা জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পুরান ঢাকায় এসব কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি যাতে না থাকে। এ ধরনের দাহ্য পদার্থের গোডাউনগুলো যাতে সরিয়ে নেওয়া হয়। আমরা দেখেছি প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর তারা এটা মেনে নিয়ে ছিলেন, এখন দেখছি তারা আবার এ কর্মটি করছেন। যার খেসারত আমাদের দিতে হলো।

এ ব্যাপারে আমরা সিরিয়াস একটা নীতিমালা তৈরি করব এবং সেটা যাতে সবাই মানে সেজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এজন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন আমাদের দক্ষিণের মেয়র। তিনি যেভাবে সহযোগিতা চাইবেন বা চাচ্ছেন আমরা সেই কাজটিই করছি।

নীতিমালা করার বিষয়টি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়, উচ্ছেদ কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে কি না- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, মোটেই না। প্রধানমন্ত্রী এখান থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। তবে যারা বাধা দিয়েছেন তাদের ভুল ভাঙবে, তারা নিজেরাই সহায়তা করবেন সরিয়ে নেওয়ার জন্য।

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করব। এটা আমরা খুব ম্যাথডিক্যালি দেখছি যাতে কোনো কিছু বাদ না যায়। আমাদের হয়ে গেছে প্রায়। আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা দেব।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অর্ধশত। প্রাথমিক তদন্তে আগুনের কারণ হিসেবে কেমিক্যালকেই দায়ী করা হয়েছে। কেমিক্যালের গোডাউন ও বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এরপরই পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে টাস্কফোর্স। ব্যবসায়ীদের বাধা ভেঙে এই অভিযান চলে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads