• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বঙ্গবাজারের ৪ ইউনিটই অগ্নিঝুঁকিতে

বঙ্গবাজার

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

বঙ্গবাজারের ৪ ইউনিটই অগ্নিঝুঁকিতে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০১৯

অতীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সতর্ক হননি রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। আর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর মার্কেটটিকে চরম অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ নেই খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। ১৯৯৫ সালে রাজধানীর সব বড় পাইকারি কাপড়ের এই মার্কেটটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে দুর্ঘটনায় ওই এলাকায় অধিকাংশ দোকানই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরবর্তীতে তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন সেখানে নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে গড়ে তোলে টিন-কাঠ দিয়ে নির্মিত দুই ও তিন তলাবিশিষ্ট চার ইউনিটের ‘বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স’ নামে কাপড়ের পাইকারি মার্কেট। সর্বশেষ গত বছর ২৪ জুলাই আবারো আগুন লাগে এই মার্কেটের কয়েকটি দোকানে। তবে তৎক্ষণাৎ ফায়ার সার্ভিসের প্রচেষ্টায় সে আগুনের ভয়াবহতা বেশি বিস্তার ঘটাতে পারেনি।

এরও আগে ফায়ার সার্ভিসের একটি পরিদর্শক কমিটি ২০১৭ সালে বঙ্গবাজারের চারটি ইউনিটকে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট, আদর্শ ইউনিট) ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ চিহ্নিত করে বাজার কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়। তবে বাজার কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স সব ধরনের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিনই এখানে দেশি-বিদেশি হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়। তিনতলা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটের পাটাতন এবং সিলিং কাঠ দিয়ে তৈরি। নিচতলায় ইট-সিমেন্টের তৈরি পিলার থাকলেও পুরো মার্কেটটি টিন ও কাঠের তৈরি। মার্কেটের ভেতরে গলিপথগুলো খুবই সরু। সরেজমিন দেখা যায়, মার্কেট গলির বিভিন্ন পয়েন্টে অগ্নিনির্বাপণে এক্সটিংগুইশার থাকলেও পুরো মার্কেটের কোথাও স্মোক/হিট ডিটেক্টর, ফায়ার হোজরিল, পাম্প, ফায়ার অ্যালার্ম বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। সিলিংয়ে বৈদ্যুতিক তার ঝুঁকিপূর্ণভাবেই থাকতে দেখা গেছে। তৃতীয় তলায় মার্কেট কর্তৃপক্ষের অফিস এবং মসজিদ রয়েছে। রাজধানীর অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ এক হাজার ৩০৫টি বিপণিবিতানের মধ্যে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় গড়ে ওঠা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটই অগ্নিঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে।

তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট কর্তৃপক্ষের দাবি, বঙ্গবাজারে আগুন লাগার কোনো ঝুঁকি নেই। মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি অধিদফতরের একটি পরিদর্শন কমিটি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটকেই ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে একই বছরের ১৭ মে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিশ দেওয়া হয় এবং এর পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। নোটিশ দেওয়ার ৮ মাস পর ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি ইউনিট পুনরায় পরিদর্শন করে মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনরায় ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হয়। এরপর জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০০৬ এবং অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ মোতাবেক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিটে অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষকে পুনরায় নোটিশ ও স্মরণিকা দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আরো দুই দফা নোটিশ দেওয়া হয়।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেনেন্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘বঙ্গবাজার সবচেয়ে বেশি অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। পুরো মার্কেটটি কাঠের তৈরি, সেখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবাজার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে চার-পাঁচবার নোটিশ ও স্মরণিকা দিয়ে সতর্ক করেছি, কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।’

ফায়ার সার্ভিসের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীর এক হাজার ৩০৫টি শপিং মল/মার্কেট ও বিপণিবিতানের মধ্যে ৬২২টি ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং ৬৭৮টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত। মাত্র পাঁচটিকে ‘সন্তোষজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।

বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা সব সময় ঝুঁকিতে ব্যবসা করছেন। আগে একবার মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল, এরপর থেকে মার্কেট কর্তৃপক্ষ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (এক্সটিংগুইশার) রাখছে। কিন্তু এই সিলিন্ডার তারা চালাতে জানেন না।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির আইন বিষয়ক সম্পাদক দুলাল আহমেদ খান দাবি করেন, বঙ্গবাজার কোনোভাবেই আগুনের ঝুঁকিতে নাই। আমরা সচেতন আছি, মার্কেটের প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা আছে। ব্যবসায়ীদের বলা আছে, মার্কেটের ভেতরে ধূমপান করা, মোমবাতি, দিয়াশলাই জ্বালানো যাবে না। যদি কেউ এই নিয়ম ভাঙে তার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিসের তরফে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ’ বলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস কীভাবে বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে? অন্য মার্কেটে আগুন লাগে, সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ না বলে বঙ্গবাজারকে কেন ঝুঁকিপূর্ণ বলছে? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে।’

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স গাঘেঁষেই ১৮ হাজার বর্গফুট নিয়ে রয়েছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মহানগর ইউনিট। এর পাশে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স (গুলিস্তান ইউনিট) এবং তার পাশে আদর্শ ইউনিট। এই তিনটি মার্কেটও তিনতলার। এই তিনটি মার্কেটেই চারটি করে সিঁড়ি রয়েছে। এই তিনটি মার্কেটের সিলিং ও পাটাতন কাঠের তৈরি। নিরাপত্তার স্বার্থে এই মার্কেটগুলোর প্রতিটি তলায় একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা আছে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মহানগর ইউনিটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের মার্কেটে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র কর্তৃপক্ষ দেয়নি। তারা আগুন আতঙ্কের মধ্যেই সব সময় থেকে যাচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার আগে রেলের জায়গায় এই বঙ্গবাজার মার্কেটের গোড়াপত্তন। শুরুতে ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও হকাররা বসতেন। ফুলবাড়িয়ায় তখন ঢাকার প্রধান রেলস্টেশন ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ টিনশেড দোকানগুলো ভেঙে পাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে রেল কর্তৃপক্ষ মালিকানা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দোকানিরা ইজারা নিয়ে দোকান বসানোর অনুমতি পায়। ১৯৮৫ সালে সিটি করপোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালে সেখানে মার্কেট নির্মিত হয়। তখন থেকেই এটির নাম হয় বঙ্গবাজার। ২১ হাজার ২৫০ বর্গফুট আয়তনের এই বঙ্গবাজার ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাকের বড় বাজার হিসেবে পরিচিতি পায়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads