• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
মডেল শহর হচ্ছে পুরান ঢাকা

ছবি : সংগৃহীত

মহানগর

মডেল শহর হচ্ছে পুরান ঢাকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০১৯

পুরান ঢাকাকে মডেল শহর করতে চায় সরকার। নির্ধারিত সাত স্থানকে মডেল ধরে নগর পুনঃউন্নয়নের (আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট) মাধ্যমে পুরনো সব ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের নির্ধারিত জমিতে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুরনো ঢাকাবাসীকে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।

চিহ্নিত এলাকাগুলো হচ্ছে পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, চকবাজার, মৌলভীবাজার, বংশাল, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগ। এসব এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে মডেল টাউন গড়ে তোলা হবে। পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকাকেই এর আওতাভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে উন্নত বিশ্বের আদলে শত শত বছরের বনেদি পুরান ঢাকা হবে নতুন মডেল শহর।

ইতোমধ্যে পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরি করেছে রাজউক। সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা ও সভা সমাবেশ করে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সফলতা পেলে এর আদলেই গোটা পুরান ঢাকার সব পুরান ও ছোটবড় ভবন ভেঙে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার শহর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

রাজউক সূত্র জানায়, সম্প্রতি চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজউক বংশাল ও হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকাসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের জন্য একটি অফিস আদেশ জারি করে। আদেশে আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প গ্রহণের জন্য সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সব সদস্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সমন্বয়ে একটি টিম পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে। কমিটি সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ, ডিটেইল্ডস এরিয়া প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) প্রকল্পের সার্ভে ডাটাবেজের ভিত্তিতে সম্ভাব্য সাতটি প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করে। এর মধ্যে প্রথম এলাকা ইসলামবাগের প্রায় ১৪ দশমিক ৯৪ একর জমি, দ্বিতীয় এলাকা চকবাজারে প্রায় এক দশমিক ৪৭৪ একর জমি, তৃতীয় এলাকা মৌলভীবাজারে শূন্য দশমিক ৬০ একর জমি, চতুর্থ এলাকা বংশালে প্রায় ১২ দশমিক ৭১ একর জমি, পঞ্চম এলাকা হাজারীবাগে প্রায় ১১১ শূন্য দশমিক তিন একর জমি, ষষ্ঠ এলাকা কামরাঙ্গীরচরে প্রায় ৩৩ দশমিক ৭৬৩ একর জমি ও সপ্তম এলাকা হিসেবে লালবাগে প্রায় ৩২ দশমিক ৭২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করে।

রাজউক সূত্র জানায়, এসব সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করতে ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কমিটি দশটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে- ১. সম্ভাব্য সাতটি প্রকল্প এলাকার সীমানা চূড়ান্তকরণের জন্য এবং উক্ত এলাকাসমূহে নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের জন্য বিস্তারিতভাবে ভৌত ও আর্থ-সামাজিক জরিপ, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা, পরিবহনগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পাদন করতে হবে। এলাকার বাসিন্দা বা জীবিকা নির্বাহকারী জনসাধারণসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা (পিআরএ সেশন) আয়োজন করে সেই মোতাবেক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। ২. নগর পুনঃউন্নয়ন (আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট) প্রকল্প গ্রহণ বিষয়ক একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে চূড়ান্তকরণ করা, ৩. প্রকল্পভুক্ত এলাকাগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাদি সংরক্ষণ করতে হবে এবং স্থানীয় বৈশিষ্ট্যাবলি বজায় রেখে নগর পুনঃউন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, ৪. নগর পুনঃউন্নয়ন (আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট) প্রকল্পে প্রকল্প এলাকাভুক্ত সাধারণ জনগণ যেন মূল সুবিধাভোগী হন তা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত এলাকায় প্রস্তাবিত নাগরিক সুবিধাদি উক্ত এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের চাহিদার নিরিখে এবং নগর পরিকল্পনার যথাযথ মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংস্থান করতে হবে, ৫. ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সব সরকারি দফতর বা সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক রাজউক কর্তৃক নগর পুনঃউন্নয়ন (আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট) প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে, ৬. নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান প্রধান সড়কের সঙ্গে প্রকল্প এলাকার সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. পুরান ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানজট নিরসন এবং ভবিষ্যৎ নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে কার্যকর করার লক্ষ্যে গোটা পুরান ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক চিহ্নিত করে ট্রাফিক প্রভাব সমীক্ষা সম্পাদনপূর্বক বিদ্যমান সড়ক সম্প্রসারণ, নতুন সড়ক নির্মাণ ও ট্রাফিক চাহিদা ব্যবস্থাপনা (ট্রাফিক ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট) ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, ৮. নাজিমউদ্দীন রোড ও বকশীবাজার-চকবাজার রোড পুরান ঢাকার অন্যতম দুটি প্রবেশদ্বার। রাস্তা দুটিকে ৬০ ফুট প্রশস্ত করার প্রস্তাবনা আছে। নগর পুনঃউন্নয়ন (আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট) প্রকল্প ফলপ্রসূ করার স্বার্থে ড্যাপের প্রস্তাব অনুযায়ী রাস্তা দুটিকে জরুরি ভিত্তিতে প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, ৯. এসব এলাকার যেসব ভবন অপেক্ষাকৃত নতুন নির্মিত ও কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিমুক্ত, সেসব ভবন যথাযথভাবে যাচাই সাপেক্ষে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে ওসব ভবন মালিককে বেটারমেন্ট ফি দিতে হবে। এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধি-বিধান নগর পুনঃউন্নয়ন বিধিমালা বা নীতিমালায় সংযোজন করা, ১০. নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প চলাকালীন জনগণের অন্তর্বর্তীকালীন আবাসন সুবিধা প্রদানকল্পে প্রকল্প এলাকার সন্নিকটে সুবিধাজনক স্থান চিহ্নিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আবাসন ব্যবস্থা প্রকল্পের আওতায়ই নিশ্চিত করা।

এ-বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরান ঢাকাকে পুনঃনগর উন্নয়নের জন্য আমরা নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যাচাই-বাছাই করতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছি। একমাত্র এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সিঙ্গাপুর, উত্তর কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের অল্প জমিতে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে আজ সুন্দর নগরী গড়তে সফল হয়েছে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় পুরান, জরাজীর্ণ ভবনগুলো অপসারণ করে তাতে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। যার ফলে ভূমির উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা তৈরি করে সেখানে পার্ক, খেলার মাঠ, প্রশস্ত রাস্তাসহ অন্যান্য আবশ্যিক নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে এর মাধ্যমে পুরান ঢাকার হেরিটেজ ভবনগুলো সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার জন্য গৃহীত কমিটির মতে, পুনঃনগর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভারতের মুম্বাই, গুজরাট, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ সিঙ্গাপুর হচ্ছে অন্যতম মডেল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জনবসতি ও ঘিঞ্জিপূর্ণ এলাকার পুনঃউন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে পুরো পুরান ঢাকার চেহারাই পাল্টে দেওয়া সম্ভব। প্রকল্পের মাধ্যমে একাধিক ভূমি মালিকের জমি একত্রিত করে বহুতল ভবন করে আনুপাতিকভাবে বণ্টন করা হবে। এর ফলে ওই এলাকার সড়ক প্রশস্ত করা, পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা তৈরি করা, ভবনের উন্মুক্ত জায়গাসহ আধুনিক আবাসিক এলাকার সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।  এ ছাড়া প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত, ঘনবসতিপূর্ণ, অপ্রতুল নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন এলাকাকে বসবাসকারীদের চাহিদা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকল নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন ও একটি পরিকল্পিত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার স্থানীয় ভূমি মালিক ও হাজারীবাগের পুরান ট্যানারি মালিকরা রাজউকের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে রাজউককে চিঠি দিয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, পুরান ঢাকাবাসী বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। এ অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তরণ জরুরি। তবে উন্নয়ন করতে গেলে প্রথমেই এসব এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থাও করতে হবে। অন্যথায় তারা কোথায় থাকবে এই অনিশ্চয়তার কারণে নাগরিকরা পুনঃনগর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তাই সবার সঙ্গে আলোচনা করে ও তাদের সরিয়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করা পুরান ঢাকাবাসীর সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা অতি জরুরি।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, পুরান ঢাকাকে নগর পুনঃউন্নয়ন করে নাগরিকদের সুন্দর জীবনের স্বাদ দিতে চাই। এ জন্য সরকার পুরান ঢাকার সম্ভাব্য সাতটি স্থানকে সাত সেক্টরে ভাগ করে জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া ও ভারতের মুম্বাই ও গুজরাটের আদলে কম জমিতে অধিক নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য পুনঃনগর উন্নয়নে কাজ করবে। এসব প্রকল্পে পার্ক, খেলার মাঠ, জলাধার, খোলা স্থান, আধুনিক ও নাগরিকদের জন্য সব ধরনের সুবিধা থাকবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজউক অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরান ঢাকাবাসীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমরা এই নির্দেশ বাস্তবায়নে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি।

পুরান ঢাকাবাসীর জীবনমান উন্নয়ন করতেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি এলাকাবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads