• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মিরপুর বস্তি ঘিরে কোটি টাকার বাণিজ্য

ছবি : সংগৃহীত

মহানগর

মিরপুর বস্তি ঘিরে কোটি টাকার বাণিজ্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৯

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর, চলন্তিকা ও আরামবাগ বস্তিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সরকারদলীয় ক্যাডার ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-ওয়াসা কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্য রুম কিনে তা ভাড়া দেওয়া, বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ দিয়ে মাসে উপার্জন করেছেন কোটি কোটি টাকা। ফলে সরকারকেও হারাতে হয়েছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব।

শুক্রবার সন্ধ্যায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিতে। এরই মধ্যে এই অগ্নিকাণ্ড ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিযোগ করেছেন বস্তিবাসী। একই সঙ্গে এই বস্তিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের রমরমা ব্যবসা এতদিন ধরে চলে আসছিল বলেও অভিযোগ তাদের।

কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৫-৩০ বিঘা জায়গার ওপর গড়ে ওঠে এই বস্তি এলাকা। প্রায় ৩০ হাজার ঘর আছে এখানে। বস্তিবাসী এবং আশপাশের এলাকার মানুষজন বলছেন, প্রতিটি ঘরেই ছিল গ্যাসের সংযোগ। অভিযোগ আছে, স্থানীয় ‘নেতারা’ই নিয়ন্ত্রণ করতেন গ্যাসের অবৈধ এই ব্যবসা। বস্তির ঘরগুলো থেকে প্রতি চুলায় এক হাজার টাকা করে বিল আদায় করতেন নেতাদের লাইন ম্যান। সেই হিসেবে মাসে দুই কোটি টাকারও বেশি অবৈধ গ্যাস বিলের দারুণ এক ব্যবসা ক্ষেত্র ছিল মিরপুরের সবচেয়ে বড় এই বস্তি।

সালমা নামের বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, সরকার খালি বলে অবৈধ অবৈধ, এগুলা তো নেতা-ফেতারা খাইতেছে। আমরা কি অবৈধ রাখছি, নাকি নেতা-ফেতারা অবৈধ রাখছে? আমরা তো বিল দিই। পানির বিল দিই, বিদ্যুতের বিল দিই, গ্যাসের বিল দিই। এক চুলায় এক হাজার টাকা করে বিল খাইছে (লাইনম্যানরা)।

বস্তির আরেক বাসিন্দা সুমিও এর সঙ্গে যোগ করে বলেন, আমরা তো সবকিছুর বিল দিছি। কাদের কাছে এসব বিল দিয়েছেন, আর নেতারাই কারা এমন প্রশ্নের জবাবে সালমা বলেন, এইডির নাম বলা যাবে না। নেতা-ফেতার নামের অভাব নাই। আশেপাশেই থাকে, এডি কি দূরে থাহে?

নাম প্রকাশে জীবনের ঝুঁকি আছে উল্লেখ করে সুমি বলেন, নাম না নেওয়াতেই এতকিছু, নাম নিলে তো আমগো মাইরাই ফালাইব।

গতকাল সরেজমিনে জানা যায়, যারা এতদিন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জন করে আসছিলেন, আগুন লাগার পর কেউ বস্তিবাসীদের খোঁজ নিতে আসেনি। শুধু রুমের মালিকরা নয়, যারা বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি বিল নিচ্ছিলেন তারা আগুন লাগার পর একবারো আসেননি।

শাহীনুর বেগম ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। চার মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী সেলিম মিয়া বাবুর্চির কাজ করেন। তিন মেয়ে স্কুলে পড়ে। বইখাতা পোশাক সব পুড়ে গেছে। শনিবার সকালে গ্রাম থেকে ফিরেই জানতে পারেন আগুনের সংবাদ। শাহীনুর বেগম বলেন, ‘যে মালিকের (সালাম মিয়ার বাসা) বাসায় ভাড়া ছিলেন তিনিও খোঁজ নেননি। অথচ কয়েকদিন আগেও মাসের ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল বাবদ কতগুলো টাকা পরিশোধ করেছি। মালিককে ফোন দিলেও রেসপন্স করেননি।’

শাহীনুর শুধু নয়, মালিকের প্রতি অভিযোগের তীর আরো অনেক ভাড়াটিয়ার। মিনু বেগম তার ছেলে মিরাজ ও স্বামী কামালকে নিয়ে ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চে ওঠেন। জানতেই পারেননি যে, ভয়াবহ আগুনে তার সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। গতকাল এসে সবকিছু পোড়া দেখেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। মিনু বেগম বলেন, সকালে মালিক মাজেদ মিয়ার বাড়িতে গেলেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, নিজের ২০টি ঘর পুড়ে গেছে। সে চিন্তাতেই তো বাঁচি না। ঘর করতে পারলে আবারো তোমরা থাকবে, এখন কথা বলার সময় নেই।’

মিনু বেগম জানান, প্রতি মাসে ঘর ভাড়া বাবদ দুই হাজার ৭০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৩০০ টাকা আর গ্যাস বিল বাবদ ৫০০ টাকা করে দিতে হতো। তার মালিকের ২০টি ঘর ছিল। ২০ ঘর থেকেই মালিক গ্যাস বিল বাবদ ৫০০ টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা তুলত। ভাড়া পরে দিলেও চলত তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের টাকা সবার আগে নিত। পানির জন্যও ১০০ করে টাকা দেওয়া হতো।

গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির মিটার বাড়িগুলোতে ছিল কি না জানতে চাইলে মিনু বেগম বলেন, ‘কোনো বাসাতেই গ্যাস আর বিদ্যুতের মিটার ছিল না। সবই অবৈধ সংযোগ ছিল। তবে পানির মিটার ছিল। মালিকরা পানির বিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করেন বলে শুনেছি।’

বস্তির ঝিলপাড় অংশের একজন মালিক মোছা. ময়না বেগম বলেন, ‘আমার ৩০টি ঘর ছিল, যার চিহ্ন মাত্র নেই। ওইসব ঘরের দ্বিতীয় তলায় চারটিতে দুই মেয়ে, এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। বাকি ২৬টি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। রুম ভেদে ভাড়া ছিল ২২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। রুম ভাড়ায় যে উপার্জন হয় তা থেকে ‍দুলাল নামে একজনকে গ্যাস বাবদ ৫ হাজার টাকা ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। এই দুলালই ঝিলপাড় অংশে যত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ রয়েছে তার সবই দিয়েছেন। প্রতি মাসে টাকাও কালেকশন করেন তিনি। এই অংশে কতগুলো ঘর ছিল জানতে চাইলে ময়না বেগম বলেন, ‘প্রায় ১০ হাজার ঘর ছিল। সব টাকাই দুলাল এসে নিয়ে যায়।’

দুলাল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় সবাই দুলালকে এক নামে চেনে। গ্যাস দুলাল বললে সবাই চেনে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা তার।’

গ্যাস দুলালকে অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া যায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ আর বিদ্যুৎ সংযোগের কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘আমি কোটি টাকা তুলি, টাকাগুলো যায় কোথায় জানেন? সবাইকে দিয়ে খাই। কে খায় না সেটাই বলেন? গ্যাস ও বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরাও এখানকার টাকার জন্য বসে থাকেন। ফোনের ওপর ফোন করতে থাকেন।’

আরামবাগ অংশে একজন মালিককে পাওয়া যায়। তার নাম আলমগীর হোসেন। গার্মেন্টে উচ্চপদে চাকরি করেন। দেড় বছর হলো দুই লাখ টাকায় ৭টি ঘর কিনেছেন। এরপর সেখানে দু মাস আগে ৯৬ হাজার টাকা খরচও করেছেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আরামবাগ অংশে অন্তত ৮ হাজার ঘর রয়েছে। এখানকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের টাকা রহিম শিকদার নামে একজন লোক প্রতি মাসে নেন।’ আরামবাগ অংশের চারটি ঘরের মালিক জাকির হোসেনও জানান যে, রহিম শিকদারই তাদের বিদ্যুৎ আর গ্যাস বিলের টাকা নেন। গ্যাসের জন্য প্রতি ঘর বাবদ ৫০০ টাকা আর বিদ্যুতের জন্য ৩০০ টাকা করে নেন।

নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বস্তিবাসীদের কয়েকজন বলেন, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একাধিক গ্রুপ সমঝোতার ভিত্তিতে এলাকা ভাগ করে বস্তির এই অবৈধ গ্যাসের বাণিজ্য পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। কেউ কেউ অভিযোগের তীর তাক করেন স্থানীয় কাউন্সিলর মো. রজ্জব হোসেনের দিকে। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন। অবশ্য বস্তিতে এই অবৈধ ব্যবসা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বা আমাদের দলের কোনো সদস্য এই টাকা নেয় না। বিএনপির লোকজন বস্তি থেকে এই টাকা খায়। কিছু আছে যারা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা এসবের লেবাসধারী, পরিচয় দিয়ে এই টাকা নেয়। এরা এসব সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যও না। এদের পরিচয় ঘাঁটেন যে এরা আগে কি করত। দেখা যাবে বিএনপির, ছাত্রদলের বা যুবদলের।

অন্যদিকে বস্তিতে গ্যাসের অবৈধ কোনো সংযোগই নেই দাবি করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৬) ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। এক প্রশ্নের জবাবে এই সংসদ সদস্য বলেন, কেউ যদি বলে এখানে গ্যাসের অবৈধ লাইন আছে, আমি আজো পাইনি। কারণ আমি এই এলাকায় বসবাস করি। প্রত্যেকটা মানুষের খোঁজখবর রাখি। এরপরও কেউ যদি বলে থাকে, তাহলে ঐ ব্যক্তিটা কে— আমাকে দেখতে হবে।

ইলিয়াস মোল্লা আরো বলেন, কাউকে গ্যাসের লাইন নিতে হলে তার বাড়ির ঠিকানা লাগে, বিদ্যুৎ বিল লাগে, দলিলপত্র লাগে, পর্চা লাগে। তিন বছর ধরে গ্যাস (সংযোগ দেওয়া) টোটালি বন্ধ। বাট এখানে কোনো অবৈধ গ্যাস নাই।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তদন্ত প্রতিবেদনের পর জানা যাবে বলে জানিয়েছেন তিতাসের ঢাকা মেট্রো বিপণন বিভাগ-৬ (মিরপুর-১০)-এর উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। অনেক এলাকা চিনিও না এখনো। তাই বলতে পারছি না। রূপনগরের ঘটনায় আমাদের একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তারা রোববারও ঘটনাস্থলে গিয়েছে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এই অবৈধ সংযোগের বিষয়ে জানা যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads