• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

পুরান ঢাকায় দেদার চলছে রাসায়নিক ব্যবসা

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০১৯

পুরনো রূপে ফিরে আসছে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসা। সিটি করপোরেশনসহ দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এই রাসায়নিকের ব্যবসা ও মজুত বেড়েই চলেছে। অথচ গত এক বছরে রাসায়নিক দ্রব্য থেকে পুরান ঢাকায় আগুনের ঘটনা অন্তত সাড়ে চার শ। পুরান ঢাকার যত্রতত্র এ ব্যবসার কারণে আবারো চুড়িহাট্টার মতো বিপর্যয়ের শঙ্কা করছে বুয়েটের কেমিক্যাল বিভাগ।

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের রাসায়নিক গুদামের আগুনে মারা যান অন্তত ৭১ জন। এর পরপরই রাসায়নিকের মজুত সরাতে অভিযানে নামেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। গুদাম অপসারণে টানা অভিযান চালিয়েছিল বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে রাসায়নিক গুদাম অপসারণে নির্দেশনা ছিল টাস্কফোর্সের। কিন্তু ১০ মার্চ পর্যন্ত অভিযান চললেও পরে তা থেমে যায়।

টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা জাহিদ হাসানের দাবি, চুড়িহাট্টার ঘটনার পর তারা অভিযান চালিয়ে রাসায়নিক গুদাম অপসারণ করেছেন। এখন তাদের পুনর্বাসনসহ অন্যান্য দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরমানিটোলার আরিফ ম্যানশনের বেজমেন্টে মজুত করা হয়েছে ৪০ হাজার লিটার প্যারাফিন। অথচ আটতলা এ ভবনে থাকছে কয়েক শ মানুষ। আশপাশের ভবনেও রাখা হয়েছে অ্যাসিড ও ডাইং-পারফিউমের নানা রাসায়নিক। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, বাবুবাজারসহ নানা এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই এখনো আছে কেমিক্যালের গুদাম। আছে দোকানপাটও। ৩৪টি অতি দাহ্য রাসায়নিক সরিয়ে ফেলার কথা জানিয়ে ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, মজুত করা এসব রাসায়নিকে কোনো ঝুঁকি নেই। তবে পুরান ঢাকায় যে রাসায়নিকের মজুত রয়েছে তা আগুনের সংস্পর্শে এলে চুড়িহাট্টার মতো আরো একটি বিপর্যয়ের শঙ্কা করছে বুয়েটের কেমিক্যাল বিভাগ।

চুড়িহাট্টার আগুনের পর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ অবস্থা আবারো অভিযানে নামার পরিকল্পনা করছে তারা।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, গত এক বছরে পুরান ঢাকায় ছোট-বড় সাড়ে চার শতাধিক আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির কারণ মজুত করা রাসায়নিক।

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। অস্থায়ী গুদাম তৈরি করতে টঙ্গী ও শ্যামপুরে ১২ একর জায়গাও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু গত আট মাসেও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ১৬৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ হয়নি একটুও। এমনকি টঙ্গী ও শ্যামপুরের নির্ধারিত জায়গা দুটি এখনো দখলমুক্ত হয়নি। তার পরও শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, এক বছরের মধ্যে শুরু হবে স্থানান্তর।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, টঙ্গীতে বিএসইসির এই জমিতে বসতি গড়েছে প্রায় পাঁচ শ পরিবার। রয়েছে গুদামঘরসহ ছোট ছোট কারখানাও। এখানে ৮৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ৫৩টি রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ হবে। এখন পর্যন্ত মাত্র একবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। অবৈধ দোকানপাট ছাড়াও এখানে ইটের খোয়া ও বালু ব্যবসা চলছে। এ জায়গায় ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম নির্মাণের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ শুরু না হলেও ২০২০ সালের মধ্যে প্রস্তুত করতে চায় শিল্প মন্ত্রণালয়।

শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সেখানে ৬ দশমিক ১৭ একর জমিতে ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার প্রবেশ মুখের পাশ ভেঙে সেখান দিয়ে ট্রাক চলাচলের রাস্তা করা হয়েছে। কয়েক শ ট্রাক রেখে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। অবৈধ দোকানপাট ছাড়াও সেখানে ইটের খোয়া ও বালু রেখে ব্যবসা চলছে।

উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুস সাত্তার বলেন, চুড়িহাট্টার ঘটনার পর এখান থেকে কিছু অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়। মাটি পরীক্ষা করা হয়। পরে আর কোনো কাজ হয়নি।

এর আগে ২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প চূড়ান্ত করতেই লেগেছিল আট বছর। সেটি মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক আগেই। এবার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে তিন বছরের মধ্যে শিল্পনগর গড়তে চাচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

শিল্প সচিব মো. আবদুল হালিম বলেন, জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর ব্যবসায়ীরা সেখানে অবকাঠামো  তৈরি করবেন। এতে সময় লাগবে। অস্থায়ী গুদাম তৈরিতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নথিগত কাজ শেষ করা হয়েছে। এখন সংস্থা পর্যায়ে কাজ হবে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন বলেন, অস্থায়ী গুদামে যাওয়ার জন্য চুক্তির বিষয়ে কেউ তো তাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। গুদামের ভাড়া কত হবে, কী শর্তে ব্যবসায়ীরা সেখানে যাবেন, এসব বিষয় এখনো অজানা। তিনি বলেন,  দেখবেন, আরেকটি দুর্ঘটনার পর সবাই নড়েচড়ে বসবে।

অনেকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক সামগ্রী গোপনে বিক্রি করছেন বলে স্বীকারও করে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল জলিল। তিনি বলেন, তাদের সতর্ক করা হলেও তারা তা মানছেন না। ঢাকার বাইরে রাসায়নিক পল্লীর জন্য বহুবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা সহযোগিতা করেনি।

পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকমুক্ত করার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, এ ধরনের কাজ সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকতে হয়। রানা প্লাজার ঘটনার পর সেটি অগ্রাধিকারে ছিল বলেই পোশাক খাতে বেশ কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে মনে হয়, রাসায়নিক সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকারে থাকে না। সরকার এটিকে অগ্রাধিকার দিলেই কেবল সম্ভব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads