• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
হযবরল নির্বাচনি প্রচারে পোস্টারদূষণ

প্রতীকী ছবি

মহানগর

হযবরল নির্বাচনি প্রচারে পোস্টারদূষণ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ঢাকার জোড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে। এ নির্বাচনের প্রচারে ব্যবহূত পোস্টার-ব্যানার নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তা অপসারণের কাজ শুরু হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রচারে প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিকল্প কিছু নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি।

তাদের মতে, পোস্টার দেওয়ালে বা কোনো স্থাপনায় না সাঁটাতে দিলেও টানানো পোস্টার নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে নির্দিষ্ট ব্যবধানে সিটি করপেরেশনের অনুমোদনে ইসি কিছু সুনির্দিষ্ট স্থান ঠিক করে দিতে পারে। অনেকটা যাত্রীছাউনির মতো এসব স্থানে প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য জায়গা নির্ধারণ করা থাকবে। তারা এসব স্থানে পোস্টার লাগাবেন। আরো এগিয়ে পোস্টার-ব্যানার প্রার্থীদের কাছ থেকে ইসি গ্রহণ করে তারাই সাঁটানোর ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে নাগরিক শত বিড়ম্বনায় পোস্টার-ব্যানার নতুন করে ভোগান্তি হবে না।

এদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি পোস্টার অপসারণের কাজ শেষ হয়নি। এবার প্রার্থীদের লাগানো লেমিনেটেড পোস্টারে ভরে আছে নগরীর অলিগলি। অবশ্য নিজ উদ্যোগে এসব পোস্টার অপসারণের কথা ছিল প্রার্থীদের, যা এখনো করেননি তারা। নির্বাচনের আগে দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ার অঙ্গীকারও করেছিলেন তারা। সংশ্লিষ্টরা অপসারণের পর এসব পোস্টার কোন প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা হবে সে প্রশ্নও রেখেছেন। অবশ্য সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এসবের মাঝেই এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের নির্বাচনি পোস্টার থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হবে, যা পরিবেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। পরিবেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর পোস্টার দ্রুত অপসারণ না করলে নগরীর ড্রেন ও ম্যানহোলে গিয়ে জমাট বাঁধার শঙ্কা রয়েছে, যা ঢাকার জলাবদ্ধতা নতুন করে বাড়িয়ে দেবে। 

পরিবেশ আইন অনুযায়ী, পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি। পৃথিবীর কোনো দেশে নির্বাচনি প্রচারে পলিথিনের এমন ব্যবহার দেখা যায় না। যদিও ঢাকাকে আধুনিক ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রত্যয়েই দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরসহ মোট ৭৪৯ প্রার্থী অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, ২২ জানুয়ারি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় নতুন করে লেমিনেটেড পোস্টার উৎপাদন ও প্রদর্শন বন্ধের নির্দেশ দেন। রুলে সারা দেশে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লেমিনেটেড পোস্টার ছাপানো এবং প্রদর্শন বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট। নির্বাচনের পর এসব পোস্টার অপসারণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিবেশ ও নগর নিয়ে কাজ করেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, এমনি ধুঁকছে রাজধানী। অতিরিক্ত মানুষের ভারে ন্যুব্জ এ নগর ক্রমশ হুমকির দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ঢাকার অভিভাবক নির্বাচনে নতুন করে দূষণ হচ্ছে। এমন প্রচার আর চলতে দেওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে তিনি জানান। তার মতে, ‘প্রার্থীদের প্রচার কীভাবে হবে তা ইসি ঠিক করে দিতে পারে। এর জন্য তারা যাত্রী ছাউনির মতো প্রচার ছাউনি করতে পারে। যেখানে সব প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকবে। নাগরিক ওখানে ঢু দিলেই বুঝতে সক্ষম হবেন কারা কারা প্রার্থী। এতে নির্বাচনী খরচ এমনকি অপচয় কমে যাবে।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমি সব নির্বাচিত কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের অনুরোধ করব ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন সোমবারের (গতকাল) মধ্যে যেন অপসারণ করা হয়। আমরা চাই একটি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন নগর। আমরা যে গুরুদায়িত্ব পেয়েছি, সেই দায়িত্ব পালনে আমরা সচেষ্ট থাকব।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে প্লাস্টিক সামগ্রী ধ্বংসের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা দায়িত্বভার নেওয়ার পর এই প্লাস্টিক সামগ্রী যাতে দৈনিক ধ্বংস করা যায় সে বিষয়ে আধুনিক প্রযুক্তি আনার উদ্যোগ নেব।’

উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব পোস্টার লাগানো হয়েছে সেগুলো দ্রুত অপসারণের জন্য আমাদের নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের অনুরোধ করেছি। এখানে সিটি করপোরেশনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে।’ তিনি গতকাল সোমবার একাধিক স্থানে নিজেই পোস্টার অপসারণ করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমরা নিজেরা যদি করি তবে কাজটা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। আমরা সবাই পরিষ্কার আকাশ দেখতে চাই, অনুরোধ করব আমরা যদি যে যার পোস্টারগুলো নামিয়ে ফেলি তবে কাজটা ত্বরান্বিত হবে। তা ছাড়া ‘বিলবোর্ড’ করে লাভ নেই, মানুষের হূদয় জিততে হলে ‘দিলবোর্ড’ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস এম শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে পোস্টার ও নির্বাচনি প্রচার সামগ্রী অপসারণ শুরু করে দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সব এলাকায় এ অভিযান চলবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে পলিথিন রিসাইক্লিন করছি। এরপর আমাদের ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাওয়া হবে।’

একই সিটির মুখপাত্র এএসএম মামুন জানান, রোববার তারা ছয়টি এলাকার পোস্টার অপসারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের দুই হাজার ৮৫০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করছেন। আশা করি খুব শিগগিরই সব পোস্টার অপসারণ করতে পারব। এএসএম মামুন আরো বলেন, পরিবেশের কথা বিবেচনা করে আমরা এগুলো ফেলে দিচ্ছি না বা পুড়িয়ে ফেলছি না। এগুলো পুনর্ব্যবহারে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করছি।

দক্ষিণ সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা নির্বাচনের পরদিন সকাল থেকেই পোস্টারগুলো অপসারণ করতে শুরু করেছি। তবে আমার মনে হয় এটা শেষ করতে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, পোস্টারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু শুধুই কাগজের। যদি ভাঙারি সংগ্রহকারীরা এসব নিয়ে যায় এবং যারা কাগজের ব্যাগ তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে তাহলে তা খুবই ভালো হবে।

একই সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, ‘পোস্টার সরানোর জন্য প্রার্থীরা তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কেউ তা রক্ষা করেননি। তাই আমরা রোববার সকাল থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করি আগামী তিন দিনের মধ্যে আমরা পুরো ঢাকা পরিষ্কার করতে পারব। অপসারিত পোস্টার মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল নিয়ে যাবে।’

এসডোর সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, লেমিনেটেড পোস্টারগুলো ভাগাড়ে বা অন্য কোথাও ফেললে পচবে না। এগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য না। পরিচয়পত্রের মতো কিছু তৈরিতে পিভিসি বা পলিভিনাইল ক্লোরাইড আংশিকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। তবে ডাবল লেয়ার প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মেদ জানেন না যে লেমিনেটেড পোস্টারগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য না। তিনি জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিষয়টি জানিয়েছি এবং চিঠির অনুলিপি সিটি করপোরেশনগুলোতে পাঠিয়েছি, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোস্টারগুলোর ব্যবস্থা করতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছি ভবিষ্যতে নির্বাচনী প্রচারণার বিধিতে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রাখতে। পোস্টারের বদলে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সুপারিশ করেছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads