পঞ্চাশ শতক ধানি জমি এবং গোয়ালের দুটি গরু বিক্রি করে দুই বছর আগে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২-এ একটি দোকান কিনেছিলেন টাঙ্গাইলের আমির হোসেন। এখন ‘নকশাবহির্ভূত’ বলে সেই দোকানটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সব হারিয়ে এখন তিনি পথে পথে ঘুরছেন।
আমির হোসেন শুধু একা নন, তার সঙ্গে এমন আরো ৯১০ জন দোকান মালিক সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাদের দোকানগুলোর অধিকাংশই এক্সেভেটর এবং বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ডিএসসিসি। যা বাকি আছে তা-ও উচ্ছেদ চলছে। এতে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
দোকান হারানো ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দোকানগুলোর জন্য তারা ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু মিয়ার কাছে বিভিন্ন সময় মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন। তখন এসব দোকান ‘বৈধ করে দেওয়ার’ কথা বলেছিলেন দেলোয়ার। এ আশ্বাসে সর্বশেষ গত বছর দোকানপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। আবার দোকানগুলো থেকে ডিএসসিসি মাসে মাসে ভাড়াও নিত। সেই টাকা ডিএসসিসির তহবিলে জমা হয়েছে। কিন্তু এখন ‘অবৈধ’ বলে সব দোকান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সংস্থাটি।
নগর প্লাজা দ্বিতীয় তলার পূর্বপাশের সিঁড়ির নিচে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার তাজুল ইসলামের একটি দোকান ছিল। ১৪ ডিসেম্বর তার দোকানটি ফার্নিচারসহ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
তাজুল বলেন, মাত্র তিন দিনের নোটিশে আমাদের এই মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে ডিএসসিসি। তাড়াহুড়ো করে মালামাল সরাতে পারলেও দোকানের ফার্নিচার নিয়ে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। এখন এসব ফার্নিচার ইট-সুরকির নিচে পড়ে গেছে। এই মার্কেটের হর্তাকর্তা দেলু মিয়া। সিটি করপোরেশনের চেয়ে তার কথার গুরুত্ব এখানে বেশি। তার কথামতোই মার্কেটে দোকান বেচাকেনা এবং গত বছর টাকা দিয়েছেন নকশাবহির্ভূত দোকানের মালিকরা। এখন দোকান হারিয়ে পথে বসেছেন তারা।
তাজুল ইসলাম যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছিলেন আরেক ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, সিটি প্লাজার সামনে ফুটপাতে আমার তিনটি দোকান ছিল। প্রায় ১০ বছর আগে এই তিনটি দোকান কিনেছিলাম। গত বছরে এই তিনটি দোকানের জন্য দেলোয়ারের মাধ্যমে ১৮ লাখ টাকা সিটি করপোরেশনে জমা দিয়েছি। সেই টাকার রশিদও আছে। তবে বর্তমান মেয়র আমাদের কোনো কথাই শুনছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২-এর দোকান মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, ওই ৯১১টি দোকান থেকে গড়ে সাত লাখ টাকা করে ভাড়া আদায় করেছে ডিএসসিসি। এই হিসাবে ছয় কোটির বেশি টাকা করপোরেশনের তহবিলে জমা হয়েছে।
জাকের প্লাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ বলেন, নকশাবহির্ভূত দোকান অপসারণের ফলে মার্কেটের মূল ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়েছেন। তারা ডিএসসিসি মেয়রের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের তালিকা করতে ডিএসএসসি মেয়র নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তবে এসব দোকানকে বৈধ বলছেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বরং এই উচ্ছেদ অভিযানকেই ‘অবৈধ’ বলে দাবি করছেন। এ বিষয়ে সাঈদ খোকন বলেন, ‘আইনগতভাবে এসব দোকানকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও করপোরেশন সভার মাধ্যমে আমরা এসব দোকানকে বৈধতা দিয়েছিলাম। সিটি করপোরেশন ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এসব দোকানের ভাড়া পেয়েছে।’
সেই অর্থ করপোরেশনের তহবিলে জমা হয়েছে। আমি সাবেক মেয়র হিসেবে মনে করি, হঠাৎ করেই এভাবে উচ্ছেদ করা আইনসিদ্ধ নয়।’
ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন বৈধ বা অবৈধ নিয়ে বিতর্ক নয়, তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনর্বাসন চান। তারা পরিবার নিয়ে বাঁচতে চান। এই ৯১১টি দোকানের সঙ্গে মালিক-শ্রমিক মিলে লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত বলে তাদের দাবি।
গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২-এর জাকের প্লাজা, নগর প্লাজা ও সিটি প্লাজা নামে তিনটি বহুতল ভবনে নকশাবহির্ভূত দোকান অপসারণ শুরু করে ডিএসসিসি। ইতোমধ্যে সাত শতাধিক দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর অষ্টম দিনের মতো এই মার্কেটে অভিযান চলেছে।