বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

চার মহীয়সী নারীর প্রস্থান

তোমাদের অবদান- চিরকাল রবে বহমান


ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী : (জন্ম : ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ - মৃত্যু : ৬ মার্চ ২০১৮)

স্বাধীনতার মাসের শুরুতেই আমাদের ছেড়ে চলে যান স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের শিকার অসংখ্য বাঙালি নারীর মধ্যে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও একজন। তবে তিনি ব্যতিক্রম, কারণ একমাত্র তিনিই সবার সামনে অসংকোচে যুদ্ধের সময় নারীদের ওপর নির্যাতনের অবর্ণনীয় চিত্র মুখ ফুটে বলেছেন।   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের ভয়াবহ অত্যাচারের রোমহর্ষক অসংকোচ জবানবন্দি দেওয়া একমাত্র সাহসী নারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। জীবনযুদ্ধে দীর্ঘ সময় একাই পথ পাড়ি দেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তিনি নিজে শৈল্পিক এবং ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম তৈরির জন্যও ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। তার হাতের ছোঁয়ায় প্রাণহীন গাছের শেকড়-বাকড়গুলোও পেত শৈল্পিক রূপ। ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক পান। এরপর ২০১৬ সালের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় সরকার।

বীরপ্রতীক কাঁকন বিবি (মৃত্যু : ২১ মার্চ ২০১৮) 

কাঁকন বিবি নামে পরিচিতি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা (খাসিয়া নাম)। কাঁকাত বা কাঁকন বিবির প্রথমে বিয়ে হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সেনা পাঞ্জাব প্রদেশের আবদুল মজিদ খানের সাথে। বিয়ের পর কাঁকন বিবি নাম হয়। একপর্যায়ে মজিদ খান সিলেট আখালিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কাঁকন বিবিকে ছেড়ে উধাও হয়ে যান। ১৯৭১ সালে কাঁকাতের বয়স চুয়াল্লিশের মতো। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তিন দিনের কন্যাসন্তান সকিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যাওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবে এবং সম্মুখ সমরে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেওয়া হয় কাঁকন বিবিকে। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড়ের। গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফের ধরা পড়েন।  সেবারও সাতদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাকে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পরে মৃত ভেবে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে যায় পাক সেনারা।  সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাব-সেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে কাঁকন বিবি আবার ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে নিজে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সম্মুখযুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই করেন সমান দক্ষতা আর অসীম সাহসিকতার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। কাঁকন বিবির জন্ম ব্রিটিশ শাসনের অধীন থাকা ভারতের সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।

রমা চৌধুরী (জন্ম : ১৪ অক্টোবর ১৯৪১ - মৃত্যু : ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, রমা চৌধুরী তখন তিন পুত্র ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পোপাদিয়ায় পেতৃক ভিটায় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ মে রমা চৌধুরীর জীবনে নেমে আসে আঁধার কালো একদিন। এদিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় তার ওপর। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গান পাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। বিজয় অর্জনের পর ২০ ডিসেম্বর অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ছেলে সাগর। ১৯৭২-এর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আরেক ছেলে টগর মৃত্যুবরণ করে। শোক যেন তার কপালের লিখন। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আরেক ছেলে মারা যাবার পর থেকে পুত্রশোকে তিনি আর জুতা পায়ে দেননি। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে জীবন চালাতেন। সেই থেকে ২০ বছর ধরে স্বনির্বাচিত ও স্বতন্ত্র লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিভৃতে কাজ করে গেছেন এই মহীয়সী নারী। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৮টি। নিজের নিদারুণ এসব কষ্টের কথা তিনি লিখে গেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্ম মহীয়সী এই নারীর।

বীর প্রতীক তারামন বিবি (জন্ম : ১৯৫৭ - মৃত্যু : ১ ডিসেম্বর ২০১৮)

বয়স তখন ১৪ বছর। মুহিব হাবিলদার গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার প্রস্তাব দিলে তার মা কুলসুম বেওয়া রাজি হননি। পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করলে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তার মা।  কিন্তু পরে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে।  সে বছরের ১৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। এই বীর নারী ২০১৮ সালের বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১