• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

কোন পথে ভারত

  • তারেক শামসুর রেহমান
  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০১৮

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির বিজয় এবং সেখানে বিজেপি ও বিজেপি মিত্রদের সহযোগিতায় সরকার গঠন, মহারাষ্ট্রে প্রায় ৫০ হাজার কৃষকের লংমার্চ ভারতের রাজনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ দুটি ঘটনা আগামী দিনের ভারতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। একসময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে (সাত বোন রাজ্য), বিশেষ করে ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে বিজেপির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এখন সেখানে বিজেপি সরকার গঠন করেছে। আসামে এর আগেই বিজেপি সরকার গঠন করেছিল। এখন ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার গঠন করল। এ ঘটনা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে। আবার দেখা গেল, ত্রিপুরায় বাম-মনা সিপিআইএমের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলেও মহারাষ্ট্রে সিপিআইএম প্রভাবাধীন কৃষক সংগঠনের দীর্ঘ লংমার্চ (১৮০ কিলোমিটার) প্রমাণ করল মোদি ম্যাজিক উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বড় প্রভাব ফেললেও, বিজেপিশাসিত মহারাষ্ট্রে কৃষকদের সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখানে কৃষক তথা দলিতদের মাঝে সিপিআইএমের প্রভাব বেশি। দুটি ঘটনাই পরস্পরবিরোধী। ত্রিপুরায় বামরা ক্ষমতা হারিয়েছে। আর মহারাষ্ট্রে বামরা শক্তিশালী হয়েছে। অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে বিজেপি তথা এনডিএ জোটের সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। এখন বাকি শুধু মিজোরাম। সেখানে কংগ্রেস সরকার বহাল রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর সেখানে যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে লালখান হাওলার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পার্টি (৪০ আসনের মধ্যে ৩২ আসনে বিজয়ী) বিজয়ী হয়ে লালখান হাওলার নেতৃত্বাধীন সরকার সেখানে গঠিত হয়েছিল। চলতি বছরের শেষের দিকে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। মণিপুরে (২০১৭) নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন এন বিরেন সিং। আর ২০১৬ সালে অরুণাচলের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে প্রেম খানডুর নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে (২০১৮) ত্রিপুরা, মেঘালয় আর নাগাল্যান্ডে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফল প্রকাশ করা হয় ৩ মার্চ। আর এই তিন রাজ্যেই বিজেপি ও বিজেপি জোটের শরিকরা সরকার গঠন করেছে। ত্রিপুরায় বামফ্রন্টকে পরাজিত করে বিজেপি এককভাবে বিজয়ী হয়েছে (৬০ আসনের বিধানসভায় ৪১ আসন)। আর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন বিপ্লব দেব। মেঘালয়ে কংগ্রেস এককভাবে বেশি আসনে বিজয়ী হলেও (২১) মাত্র ২টি আসন নিয়ে বিজেপি তার মিত্র ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করেছে। এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর নাগাল্যান্ডে বিজেপি-এনডিপিপি জোট (৩০ আসন) সরকার গঠন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নেফিয়ু রিও। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের পতন। এই প্রথমবারের মতো বামদের হটিয়ে বিজেপি সেখানে সরকার গঠন করেছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামফ্রন্ট সেখানে ক্ষমতায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সেখানে রাজ্য সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন ১৯৯৮ সাল থেকে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৮, সময়টা একেবারে কম নয়। তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ত্রিপুরায় পরপর চারবার বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চমবার তিনি ব্যর্থ হলেন বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় নিতে। অত্যন্ত সাদাসিধে ও ‘গরিব’ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। বলা হয়, অরুণাচল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (কংগ্রেস দলীয়) গেগং আপাং ছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী। দু’দফায় (১৯৮০-১৯৯৯, ২০০৩-২০০৭) তিনি ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। একজন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে মানিক সরকারের পরিচিতি রয়েছে। বোধকরি তিনি একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যার কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। তিনি নিজে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন না। ব্যাংকে তার জমানো কোনো ব্যালেন্সও নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেতন পেতেন মাসে ২৬ হাজার ৩১৫ রুপি। কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো টাকাটা তিনি পার্টি ফান্ডে দান করতেন। তবে পার্টি থেকে তিনি মাসে ৫ হাজার রুপি ভাতা পেতেন, তা দিয়ে তার সংসার চলতো। এ ধরনের একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট হেরে গেল কেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের। তাহলে কি ত্রিপুরার মতো রাজ্যে, যেখানে বামফ্রন্ট অন্যতম শক্তি হিসেবে সমাজে বিদ্যমান ছিল, নতুন প্রজন্ম কি সেই শক্তির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলল? এ প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হবে এবং নিশ্চয়ই সিপিএম নেতারা এসব বিষয় নিয়ে ভাববেন। সেই সঙ্গে আরো একটি কথা- একসময় বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প ভাবা হতো। সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর কলকাতায় ক্ষমতায় থেকে একটি বিকল্প রাজনীতি উপহার দিয়েছিল ভারতে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর কেরালায় বাম রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি ছিল। জনগণের ভোটে তারা বারবার ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কিন্তু ২০১১ সাল থেকেই ছন্দপতন শুরু হয়েছে। প্রথমে গেল পশ্চিমবঙ্গ। এককভাবে মমতা ব্যানার্জি সিপিএম তথা বামফ্রন্টবিরোধী অবস্থান নিয়ে সেখানে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। এখন ৭ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ত্রিপুরায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারাবাহিকতায় কেরালাতেও কি বাম সরকারের পতন ঘটবে? সময়ই বলে দেবে কেরালায় বাম সরকারের পতন ঘটবে কি না? তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদি ম্যাজিক’ ভারতজুড়ে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মানুষ সেদিন মোদির কথায় বিশ্বাস রেখেছিল। মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। মোদি বিজেপিকে বিজয়ী করে দিল্লির মসনদে বসিয়েছিলেন। এরপর একটা কঠোর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। ক্ষমতায় এসে তিনি তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ নামে বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন! এ লক্ষ্যে আসামে নাগরিকত্ব গণনা কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আসামে বসবাস করে আসছিলেন, তাদের তিনি বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করলেন। অথচ এরা সবাই ভারতীয় নাগরিক। এরপর ত্রিপুরায়ও একই ঘটনা ঘটতে পারে! তিনি চেয়েছিলেন পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবেন। তবে বলেছিলেন, যারা হিন্দুধর্মাবলম্বী, তাদের বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব দেবে। মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে এটা তিনি পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারেননি এখনো। এটা ঠিক, একসময় মানুষ বিজেপির নাম জানত না। এখন জানে। এটা মোদির সাফল্য, বলতেই হবে। ইতোমধ্যেই বিজেপি ভারতব্যাপী কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় যে বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাম রাজনীতি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। অতি কঠোর হিন্দুত্ববাদ এখন দখল করছে সে জায়গা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ‘জয়যাত্রা’ থেমে গেছে। হিন্দুত্ববাদই এখন একুশ শতকের ভারতের মূল রাজনীতি! সত্তর দশকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ছিলেন। এখন সে স্থান দখল করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে এখন বিজেপি ক্ষমতায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির এখন দরকার ৮টি রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু ও মিজোরাম। দিল্লি ও পদুচেরি, যা কেন্দ্রশাসিত, সেখানেও ‘গেরুয়া শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি। এসব রাজ্যে কোথাও কংগ্রেস আর কোথাও আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায়। কংগ্রেসে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। রাহুল গান্ধী এখন কংগ্রেসের সভাপতি। কিন্তু মোদির বিকল্প হিসেবে তিনি এখনো নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তার ব্যর্থতা সেখানেই। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনের ফলই এর বড় প্রমাণ।

তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- মোদি ভারতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ধর্মনিরপেক্ষ ভারত কতটুকু বদলে যাবে? ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টি রাজ্যে তিনি গেরুয়া ঝাণ্ডা পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু দরিদ্রতা তিনি দূর করতে পারেননি। মহারাষ্ট্রের কৃষকদের লংমার্চ এর বড় প্রমাণ। একটা পরিসংখ্যান দিই। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। ভারতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন দরিদ্র। সাতটি গরিব রাজ্যে শতকরা ৬২ জন ভারতীয় বসবাস করে। শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ বাস করে অতিদরিদ্র রাজ্যগুলোতে। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে উত্তরপ্রদেশে। এরপর বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড। এরপর আছে ছত্তিসগড় ও রাজস্থানের নাম। দরিদ্রতার হার আদিবাসীদের মধ্যে বেশি, শতকরা ৪৩ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা ২১ ভাগের আছে টয়লেট সুবিধা, ৬১ ভাগের বিদ্যুৎ সুবিধা আর মাত্র ৬ ভাগ সুযোগ পান কলের পানির। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কী বলে? এর বাইরে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যার খবর আমরা জানি। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনী বিশ্বব্যাপীই আলোচিত। এসব জনগোষ্ঠীর কাছে ‘মোদি ম্যাজিক’ পৌঁছেনি। এদের উন্নয়নে মোদির কোনো কর্মসূচি নেই। ত্রিপুরায় মোদি বলেছিলেন, ‘মানিক’ ছেড়ে হীরার কথা! স্পষ্টতই তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন মানিক সরকারকে হটানোর। হীরা বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন Highway (H), I-Way (I), Roadway (R) ও Airway (A) অর্থাৎ উন্নয়ন। উন্নয়নের ‘বটিকা’ তিনি খাওয়াচ্ছেন অশিক্ষিত কোটি কোটি মানুষকে। এটা সত্য, ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। ত্রিপুরায় এসে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি, আর স্মার্টফোন দেওয়ার! মোদির উন্নয়ন পরিকল্পনার এই হচ্ছে ছবি! কিন্তু যেটা খারাপ খবর, তা হচ্ছে ত্রিপুরায় নির্বাচনের পর সংঘর্ষ হয়েছে ব্যাপক। লেনিনের স্ট্যাচু ভাঙচুর করা হয়েছে। সিপিআইএম সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একটি ‘অ্যান্টি বাম সেন্টিমেন্ট’ এখনো ত্রিপুরায় রয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক ভারতের জন্য সেটা কোনো ভালো খবর নয়। এখন দেখার পালা, ত্রিপুরার নয়া সরকার এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন।

ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনৈতিক শক্তি। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখবে। এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদ যদি ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এক ধরনের আতঙ্কে থাকবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads