• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

পশ্চিমাদের একতরফা স্নায়ুযুদ্ধ

  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০১৮

রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের স্নায়ুচাপ বাড়ছে। আর যা-ই হোক, একে যিনি দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে প্রমাণ করাতে চান তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হাস। ভদ্রলোক নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান আর কী!  আমি অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি।

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র এবং অতিসম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার যে সম্পর্ক, সেটাকে ১৯৫০-এর দশকের চেয়ে মন্দ বলতেই হয়। ১৯৬২ সালে কিউবার মিসাইল সঙ্কটের পর সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও এখন বেশ প্রবল। আজকের কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র এবং এটা নিষ্ক্রিয় রাখার কৌশলটাই জটিল এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চলমান উত্তেজনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুপক্ষের যে কেউ বা তৃতীয় কোনো পক্ষ প্ররোচিত করতে পারে— এমন যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পরিস্থিতি অধিকতর ঘোলাটে হওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এর কারণ হচ্ছে, উভয় পক্ষে আস্থা ও বিশ্বাসে ঘাটতি। রাশিয়ানদের প্রতি আমেরিকানদের অনুভূতি ঘৃণার খুব কাছাকাছি, একই সঙ্গে অনেক রাশিয়ান এখন আমেরিকানদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণের মাধ্যমে অব্যক্ত অসম্মান প্রদর্শন করেন। সত্যিকারার্থে এই মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়ে বাজে রূপ ধারণ করেছে। তার মানে এই নয় যে, বর্তমানের স্নায়ুচাপ স্নায়ুযুদ্ধের ফল। তাছাড়া মুখোমুখি সংঘাতের নেপথ্যে কিছু ভাবাদর্শিক উপাদান কাজ করে, যেটা রাশিয়ানদের মধ্যে নেই।  

আরো একটি শীতল যুদ্ধ শুরু করার অভিপ্রায় রাশিয়ার নেই। সামান্য মাত্রার সংঘাত যদিও রাশিয়ানদের জাতীয়তাবাদী আভিজাত্যের পরিচয়কে আরো একটু প্রস্ফুটিত করবে এবং জনগণকে একত্র করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য সহায়ক হবে। অথচ রাশিয়া মতাদর্শিক অভিপ্রায়ের রাষ্ট্র নয়। যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে রাশিয়ানদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেটা তারা চালান দিতে আগ্রহী নয়। মোদ্দা কথা, রাশিয়ার স্বার্থেই এই রূপান্তর ক্রেমলিন চায় না। আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। একই সঙ্গে রাশিয়া সব মানুষ ও জাতির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, যাতে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পছন্দের ক্ষেত্রে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাছাড়া স্রষ্টা, পরিবার, রাষ্ট্র এবং সমাজ ও জাতির সেবার মাধ্যমে আত্মতুষ্টির মতো বৈশ্বিক মানবিক মূল্যবোধগুলোকেও রাশিয়া সমাদর করে থাকে।

২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার ‘হস্তক্ষেপ’— অভিযোগের দুই শতাংশ সত্য প্রমাণিত হতে পারে বলে আমার ধারণা হয়। একজন রাশিয়ান হিসেবে সেই ধারণায় আমি পুলকিত হতেই পারি। তবে আমেরিকানদের মনে করিয়ে দিতে চাই, তাদের সরকার দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে। তাই এটা তাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে যে, আকাশের দিকে ঢিল ছুড়লে সেটা নিজের মাথাতেও পড়তে পারে। কিন্তু রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে যে সমস্যা, সত্যিকার অর্থে সেটা পশ্চিমাদের নিজস্ব সমস্যা। মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ইস্যু আমেরিকানরাই প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এটাকে পুঁজি করে তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া সামাজিক গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে নাখোশ সাধারণ মানুষ ও ভিন্নমতাবলম্বীরা প্রতিবাদের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। অধিকন্তু আমেরিকার অভিজাত গোষ্ঠী যদি জোরপূর্বক সেটার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়, তাহলে পশ্চিমা হালচালের গভীরে উদ্বেগ থেকেই যাবে। অবশ্য এক দশক ধরে বিশ্ববাসী পশ্চিমাদের পাঁচশ’ বছরের আগ্রাসী আধিপত্যের পতন দেখে আসছে। এই আধিপত্যের সূত্রপাত হয়েছিল ষোড়শ শতকে যখন ইউরোপে উন্নততর মরণাস্ত্র ও রণতরীর উদ্ভাবন ঘটানো হয় এবং তখন থেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ওই শতকগুলোতে ইউরোপিয়ানরা বৈশ্বিক সম্পদ কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে তাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বিশেষত সামরিক প্রভাব খাটাতে থাকে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কয়েক দশকে পশ্চিমা আধিপত্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে একক আধিপত্যের দেশ হিসেবে আমেরিকার উত্থান ঘটে এবং ধারণা করা হয়েছিল, বিশ্ব এক ঐতিহাসিক স্থিতাবস্থায় ফিরে আসবে। যা হোক, অদূরদর্শিতার প্রমাণ দিতে খুব বেশি সময় লাগেনি— ইরাক আক্রমণের মতো কিছু ভূ-রাজনৈতিক অপঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর আসে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, যার ফলে একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদের দুর্বলতাগুলো আলোচনায় উঠে আসে।

তাছাড়া বহু আগে থেকেই সামরিক অধিপতি হওয়ার বাসনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ২০০২ সালে দেশটি এককভাবে ১৯৭২ সালের দূরপাল্লার মিসাইলবিরোধী চুক্তি ভেস্তে দেয়। অধিকন্তু অতিসম্প্রতি তারা ব্যাপক হারে সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র আধুনিকায়নের ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে রাশিয়া, চীন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্বের পুনরুত্থান হতে দেবে না। কৌশলগত অস্ত্র ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে পুতিন সম্প্রতি সেই বার্তাই দিয়েছে, যাকে আমি বলব ‘শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলার প্রস্তুতি’। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক শক্তির ভারসাম্য পশ্চিমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, যাকে সংযত করা উচিত। তথাপি একটা নতুন শীতল যুদ্ধ, যদিও সেটা একপাক্ষিক; এর পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্য শক্তিশালী করার ব্যাপারে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর উচিত হবে আলোচনার দিকে মনোনিবেশ করা; সামরিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন এবং নাগরিক পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো। একই সঙ্গে কূটনৈতিক, বিধানিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিনিময়ের ব্যাপারে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

বিশ্ব এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে একটি সুষম আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। যেখানে পরাশক্তিগুলো একে-অপরকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকবে এবং বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করবে। নিজস্ব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ছোট দেশগুলোও যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত পূর্বের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধসে পড়েছে। সুতরাং একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আমাদের একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

 

লেখক : সের্জি কারজানভ (রাশিয়ার কাউন্সিল অন ফরেন অ্যান্ড ডিফেন্স পলিসির চেয়ারম্যান)

অনুবাদ : মো. রাশিদুল ইসলাম

স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads