• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

অটিজম :

সীমাবদ্ধতার আঁধারেও একমুঠো আলো

  • প্রকাশিত ০২ এপ্রিল ২০১৮

অটিজম বা অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি বলে যাদের আখ্যায়িত করে থাকি তারা আসলে আত্মনিমগ্ন বা আত্মসংবৃত ব্যক্তি। আত্মসংবৃত মানুষ নিজের ভেতর নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতে স্বাছন্দ্য বোধ করে। এই গুটিয়ে রাখা একদিন, এক মাস, এক বছর কিংবা দশ বছর নয়, এ সমস্যা বিরাজিত থাকে ব্যক্তির জীবনব্যাপী এবং বিকাশের সকল ক্ষেত্রে এর প্রভাব বিদ্যমান থাকে। মানবশিশুর বিকাশের ক্ষেত্র মূলত ছয়টি; যথা- ভাষার বিকাশ, আচরণগত বিকাশ, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ, জ্ঞানবৃত্তীয় বিকাশ, মোটরগত (ফাইন মোটর ও গ্রস মোটর) বিকাশ এবং বর্ধনগত বিকাশ। সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিকাশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিকাশের প্রায় সকল ক্ষেত্রে এর প্রভাব লক্ষণীয়। তাই অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুধু অটিজম বা অটিস্টিক শিশু না বলে অটিজম স্পেকটার্ম ডিসঅর্ডার বা এএসডি বলা অনেকাংশে সমীচীন। ‘স্পেকটার্ম’ বলতে অটিজম থাকা শিশুর নানান বিকাশজনিত ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতার ব্যাপকতাকে বোঝায়। আর এ সীমাবদ্ধতার মিথস্ক্রিয়ার কারণে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তাতে আক্রান্ত ব্যক্তির ডিসঅর্ডার সৃষ্টি হয়। এ ডিসঅর্ডার স্বল্পমাত্রা থেকে গুরুতর মাত্রায় প্রকাশিত হতে পারে।

অটিজম হচ্ছে মূলত নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ মস্তিষ্কের বিকাশ বয়স অনুসারে স্বাভাবিকভাবে না হওয়া। যার ফলে বিকাশের সকল ক্ষেত্রে কমবেশি কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হয়; যা থাকে জীবনভর। এএসডি গর্ভকালীন (জেনেটিক বা নন জেনেটিক), প্রসবকালীন ও নবজাতক অবস্থায় কিংবা পারিবারিক ও সামাজিক কারণেও হতে পারে। এএসডিতে আক্রান্ত শিশুর লক্ষণ জন্মের পরের প্রথম তিন বছরের মধ্যে দেখা দেয়। স্বাভাবিক শিশুদের মতো তাদের মোটর বিকাশ (যেমন- হাঁটা-চলা করতে না পারা বা বয়সের তুলনায় দেরিতে করা) ঘটে না, এটি বাধাগ্রস্ত হয়। বাক-বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। উপযুক্ত বয়স হলেও অর্থবহ কথা বলতে না পারা, বাক্য গঠন কিংবা শব্দ গঠন করতে না পারা, শব্দের উচ্চারণ সঠিকভাবে করতে না পারা, অনেক ক্ষেত্রে একই বাক্য ও শব্দ বার বার বলতে থাকা এই সমস্যার লক্ষণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেউ কিছু বললে সেটি সে সহজে বুঝতে পারে না। যেমন- কেউ কৌতুক, মজা বা মশকরা করলে সে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে থাকে। দৃশ্যমান লক্ষণ দেখেও অন্যের ইচ্ছে অনুধাবন করতে পারে না। যেমন- আপনি কাছ কিংবা দূর হতে কোনো বস্তু বা জিনিস আপনাকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এএসডি শিশুরা তা বুঝতে পারে না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে থিওরি অব মাইন্ড বলা হয়। যার মূল কথা হলো, ‘আমি যেভাবে চিন্তা ও কাজ করি সেই ধারার মতো অন্য কারো এ কাজ ও  চিন্তা না করতে পারা কিংবা অন্যের চাওয়া কী তা বুঝে উঠতে না পারাকে বোঝায়। তা ছাড়া অধিকাংশ এএসডি শিশু একই কাজ বার বার করে (যেমন- কোনো খেলনা বা সামগ্রীকে একইভাবে বার বার ঘোরানো), অনেকে নিজের ক্ষতিও করে (যেমন- হাত-পা কাটা, কিংবা মাথা দেয়ালে আঘাত করা)। শুধু তাই নয়, তারা তাদের মনোভাব সহজে প্রকাশ করতে পারে না কিংবা প্রকাশ করতে বেগ পায়। এর মূল কারণ তাদের ভাষা সম্পর্কিত জ্ঞান কম ও শব্দগুচ্ছ কম জানা। এ ক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এ ধরনের শিশুরা প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগলেও মুখ ফুটে তা বাবা বা মায়ের কাছে প্রকাশ করতে পারে না। তাদের অধিকাংশ আচরণে ‘কঠোর মনোভাব’ বা ‘রিজিড’ ভাব থাকে, মানে একবার মাথায় যা আসে তাই নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। কারো সঙ্গে সহজে মিশতে বা ভাব বিনিময় করতে পারে না। আবেগ, সহানুভূতি অনুধাবণ করতে পারে না। মূল কথা, শিশুর বিকাশের ছয়টি ক্ষেত্রেই কমবেশি সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে সে এএসডিতে আক্রান্ত হয়; যা সাধারণত শিশুর বাহ্যিক রূপ দেখে বোঝা যায় না। তবে শিশুভেদে এ মাত্রার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। যদি শূন্য (০) থেকে একশ’ (১০০) পর্যন্ত দাগাঙ্কিত একটি স্কেল থাকে, তবে এ ক্ষেত্রে একেক জন এএসডি শিশুর একেক বিকাশজনিত সমস্যার মাত্রা ০ থেকে ১০০-এর মাঝে একেক অংশে পড়বে। অর্থাৎ কারো ৫ হলে তার মাত্রা স্বল্প আবার কারো মাত্রা ৮৫ হলে তার মাত্রা গুরুতর হবে।

২০১৩ সালের এক জরিপ মোতাবেক বিশ্বব্যাপী  প্রায় ২১.৭ মিলিয়ন মানুষ (শিশু ও পূর্ণবয়স্ক) অটিজম-স্পেকটার্ম ডিসঅর্ডার বা এএসডিতে আক্রান্ত। আমেরিকায় প্রতি ৬৮ জন শিশুর ১ জন এএসডি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে এএসডি ব্যক্তির সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ। দেশের সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যমতে, দেশে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশের মোট প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশকে অটিজমের শিকার বলে ধরে নেওয়া হয়। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী (২০১৩-২০১৮) দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা ৪৪ হাজার ৭৮০ জন। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর হার ৩ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক ৭ শতাংশ। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী অটিজম দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবার বিশ্বব্যাপী ১১তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হচ্ছে। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশে মূলত সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করছে।

অটিজম স্পেকটার্ম ডিজঅর্ডার বা এএসডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে অপার সম্ভাবনাও নিহিত রয়েছে। তবে তা বিকশিতকরণে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং এএসডি-বান্ধব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি। যেমন- মৃদু ও মধ্যম মাত্রার অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি ভালো দৃষ্টি ও পেশির সমন্বয়ক্ষমতার অধিকারী এবং জটিল পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে থাকে, তারা কারখানায় উৎপাদনশীল কাজ এবং যন্ত্রাংশ সংযোজনের কাজে ভালো করে থাকে। যেই ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা নিম্নপর্যায়ের তাকে রেস্তোরাঁয় ন্যাপকিন ভাঁজ করার কাজে অথবা কোনো দোকানের সামগ্রী পৃথক করার কাজে প্রশিক্ষিত করা যেতে পারে। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি জোড়া লাগানো ও অফিসের কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের দক্ষতা এবং আগ্রহ অনুযায়ী মুদ্রণ, খুচরা ব্যবসা, করণিকের কাজ, ফ্যাক্টরির এবং অন্যান্য অনেক কাজই করতে পারে। প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে এইসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়মিত কর্মীদের সঙ্গে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে যেতে পারবে। তা ছাড়া অবসেশন বা বিশেষ কাজের প্রতি অতি আকর্ষণে আক্রান্ত অটিজম ব্যক্তিগণ যদি তাদের অবসেশন ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পায় তাহলে তারাও জগৎখ্যাত হতে পারে। কারণ তাদের অবসেসিভ আচরণ কোনো কাজে একাদিক্রমে নিয়োজিত থাকা- যা কেবল একটি কাজেই সকল শক্তি নিয়োগ করে বা নিবেদিত থাকে। এ কারণে তারা তাদের আকর্ষিত ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল হয়। যেমন- লুসিয়ের ফ্রয়েড একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, পরীক্ষায় সম্প্রতি যার এসপারজার সিনড্রোম ধরা পড়েছে। কথিত আছে, আইজাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন এবং মেরি কুরি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কিছু অটিস্টিক লক্ষণ ছিল। ধারণা করা হয়, চিত্রশিল্পী জেএমডব্লিউ টার্নার, সুরকার বেলা বারটক এবং দার্শনিক লুদোভিগ উইজেনস্টাইনের মধ্যেও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় জটিলতা এবং অবসেসিভ আচরণ দেখা গেছে। সুতরাং বাংলাদেশে যে হারে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে যদি বিশেষায়িত স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে এ দেশের অটিস্টিক শিশুরাও একদিন অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

 

ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া 

গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন

mahbuburrahman77@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads