• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ পথ হারিয়েছে

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ৩১ মার্চ ২০১৮

রাজপথ এবং একাদশ নির্বাচনের মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘একা’ করার বিষয়ে বিএনপির উদ্যোগটা বেশ আগের। ন্যূনতম ইস্যুতে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক ছাতার নিচে  আনার প্রক্রিয়াটা শুরু হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বৃহত্তর এই জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে একটি দলেরও ‘ইয়েস কার্ড’ মেলেনি। এতে করে এই বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে আগ্রহী দলগুলোর নেতারা বেশ বিরক্ত এবং হতাশ। এর জন্য তারা বিএনপিকেই দুষছেন। বলছেন, দলটির অহমিকা, জিয়ার আদর্শচ্যুত হওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে আগলে রাখার কারণেই পুরো প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যাওয়ার পথে। বরং নানামুখী বঞ্চনা, অবহেলায় বিদ্যমান জোট শরিকদের কারো কারো ছুটে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার এই ছক দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন নেতা ও বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে মিত্রসন্ধানী একাধিক টিমও গঠন করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই টিম  বিকল্পধারা বাংলাদেশ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, জাসদ রব, জেএসডিসহ যারা গত সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে আছে এমন দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে বলে পরিকল্পনা ছিল। কয়েকটি দলের সঙ্গে তখন বৈঠকও হয়েছিল। কিছু আসনে ছাড় এবং সরকার গঠন করতে পারলে মন্¿ণালয় ভাগাভাগি নিয়েও তখন কথা হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, সে উদ্যোগ আর এগোয়নি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার পর রাজপথে দুটি সফল যুগপৎ আন্দোলন হয়েছে। ’৯০-এর স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে এরশাদ একা হয়ে পড়েছিলেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল ’৯৬-এ। ওই সময় একঘরে হয়েছিল বিএনপি। অবশ্য আদালত ওই পদ্ধতি বাতিল করেছেন। মজার ব্যাপার, সেই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ এখন বিএনপির দাবি। তবে এখন সেরকম গণদাবিও নেই, ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যও নেই। দাবিগুলো দলীয় ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকায় জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিজেদের পদ বাঁচাতে কিছু সংখ্যক নেতা হয়তো রাস্তায় নামেন। দিলারা চৌধুরী বলেন, বিএনপি এই মুহূর্তে আছে খালেদা মুক্তির আন্দোলনে। তাদের দলীয় ইস্যুতে চাপা পড়ে গেছে জাতীয় ইস্যু। অন্যরা জাতীয় ইস্যু হিসেবে দেখছেন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে। আর সরকার কঠোর হওয়ায় রাজপথের আন্দোলন ঢুকে গেছে চার দেয়ালের ভেতরে।

আলাপকালে যুগপৎ আন্দোলনে মিত্রসন্ধানী টিমের একাধিক সদস্য বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সরকারের সমালোচনা করার মতো অনেক দল আছে, কিন্তু বিএনপির সঙ্গে রাজপথে একই সুরে স্লোগান ধরতে চায় না অনেকেই। আবার যারা চায় তাদের আছে শর্তের বিশাল বহর। এখন পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনে আসার ব্যাপারে কোনো নতুন বন্ধু পায়নি বিএনপি। মিত্র হিসেবে যেসব দলকে বিবেচনা করা হয় তাদের মতিগতিও ইদানীং সুবিধার নয়। বিশেষ করে জামায়াত ও এলডিপি। এ পরিস্থিতিতে চলতি রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ভাবিয়ে তুলেছে বিএনপিকে।

২০-দলীয় জোটের একাধিক শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের খবরকে জানান, দেশের ৪২টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩৬টি গত নির্বাচনে বিএনপির দাবির সঙ্গে সহমত ছিল। তারা নির্বাচনও বর্জন করে। কিন্তু সেই দলগুলোকে একমঞ্চে আনতে পারেনি দলটি। সেটা আর সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান খোদ জোটের শরিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। তিনি বলেন, বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা খালেদা জিয়াকে নিয়ে নাকি তাকে ছাড়াই নির্বাচনে যাবে। পরিকল্পনাহীন চলমান আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদাকে মুক্ত করা যাবে না বলে আগেই মন্তব্য করেছেন তিনি। জোটের সঠিক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির জন্য তিনি বিএনপি নেতাদের তাগিদ দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মিত্র পেতে চাইলে বিএনপিকে অহঙ্কার ছাড়তে হবে। আমি বড় দল ফলে ছোটরা যাবে কোথায়- এ মনোভাব থাকলে রাজপথে সঙ্গী মিলবে না। যারা আছে তাদের প্রতিই যে আচরণ করা হচ্ছে, তাতে বরং শরিক ছুটে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

নবগঠিত ‘যুক্ত ফ্রন্ট’ চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, দলের সংবিধান বদলে ওরা (বিএনপি) জিয়ার আদর্শচ্যুত হয়েছে, রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। আর আওয়ামী লীগ জাতীয় সংবিধান করে এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ভর করেছে। সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত দেশ এবং কলুষমুক্ত রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে উঠেছে। আমাদের মূলনীতির সঙ্গে না মিললে অন্য কারো মঞ্চেই উঠব না।

পাঁচ বছর আগে ডা. বদরুদ্দোজা খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও। যুগপৎ আন্দোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জবাবটা শুনে রাখুন, ভবিষ্যতে কাজে দেবে। যতদিন জামায়াতের সঙ্গে আছে বিএনপি যতই ডাকুক কাদের সিদ্দিকীর সাড়া মিলবে না। এটা খালেদা জিয়াকে ২০১৩ সালেই বলে দিয়েছি।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড শাহ আলম বলেন, যোগাযোগ করতে তো বাধা নেই। তবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমরা পৃথক জোট গঠনের চেষ্টা করছি।

সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না মিত্র টানায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপিকে আগে স্পষ্ট করতে হবে জনগণ, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তাদের কর্মসূচি কী? বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেই কেবল জাতীয় ঐক্য সম্ভব। শুধু মুখে মুখে জাতীয় ঐক্যের কথা বললে হবে না।

১৯৯৮ সালে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন তিন ইস্যুতে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিসকে নিয়ে জোট গঠন করে বিএনপি। সফলও হয়। ২০১৫ সালে এই জোট গড়িয়েছে ২০ দলে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত কঠোর কর্মসূচি পালন করেছিল। এরপর দলীয় ইস্যুতে আন্দোলন করলেও জোটের শরিক দলের বেলায় নীরব জামায়াত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিন হরতালের সঙ্গীও ছিল এই সংগঠনটি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads