গুচ্ছ থেকে দুইয়ে নেমে এসেছে খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্ত। এ নিয়ে পর্দার অন্তরালে আলোচনা চলছে জিয়া পরিবারের সদস্য-স্বজনদের সঙ্গে। তবে এ নিয়ে স্পষ্ট বিভেদ তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। সর্বশেষ দুই শর্ত পূরণকে আত্মসমর্পণ বা রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল বলে মনে করছে দলটির একাংশ। কারণ এর ফলে বিএনপি থেকে মাইনাস হবে জিয়া পরিবার। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে দল। অন্য অংশটির মতে, এটা হচ্ছে নেত্রীকে মুক্ত করে আনার সাময়িক কৌশল। আর জিয়া পরিবারের সদস্যরা যেকোনো শর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তি চান।
বর্তমানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অতটা ভালো নয় বলে দলীয় সূত্রে দাবি করা হয়েছে। দলটির নেতা এবং তার স্বজনদের কেউই তার সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না। ফলে দল ও পরিবারে দেখা দিয়েছে সিদ্ধান্তহীনতা। এর মধ্যে আবার দুই শর্ত তাদের করে তুলেছে আরো দিশাহারা। এ নিয়ে দলের মহাসচিব ও সিনিয়র নেতারা জিয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। খালেদা জিয়ার ভাই-বোনরাও গত শুক্রবার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। লন্ডন থেকে সার্বক্ষণিক খবর রাখছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। সরকার, বিএনপি ও জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপিপন্থি বোদ্ধা গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে সরকার। এক্ষেত্রে কৌশলী সিদ্ধান্ত নেওয়াই হবে বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আরেক বোদ্ধা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, এ বাস্তবতায় দুটি পথ সামনে খোলা আছে। হয় সরকারকে মানবিক হতে হবে, নয়তো বিএনপিকে দুর্বার আন্দোলনে নামতে হবে। এর বাইরে অবস্থা বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়াই হয়তো দেবেন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলে এর একটা বিহিত হবে বলে জানান তিনি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত ডাক্তারদের দিয়ে তার চিকিৎসা না করানো, দলের নেতা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া অত্যন্ত হীন উদ্দেশ্যমূলক। সরকারের মন্ত্রীদের এ বিষয়ে মন্তব্য ও কটূক্তি সব শিষ্টাচারের লঙ্ঘন এবং চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ। তারা কূটকৌশল করছে। কেন করছে তা জাতিও জানে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, খালেদা জিয়ার প্যারোলের ব্যাপারে বিএনপিকে দুই শর্ত দিয়েছে সরকার। এ শর্ত পূরণ হলেই প্রথমে প্যারোল, পরে স্বাভাবিক জামিন পাবেন দলনেত্রী। এরপর স্থানীয় হাসপাতাল বা চাইলে বিদেশেও যেতে পারবেন। প্রথম শর্ত হলো, বিএনপির গঠনতন্ত্র থেকে বিলুপ্ত ধারা-৭ পুনঃস্থাপন করতে হবে। যেখানে উল্লেখ ছিল, ‘দুর্নীতিবাজরা দলের কোনো পদে থাকতে পারবে না।’ দ্বিতীয় শর্ত, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, কিন্তু খালেদা জিয়া প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। এর আগে গুচ্ছ শর্তের মধ্যে ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসা, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেওয়া, জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন, ন্যূনতম ১০০ আসন নিয়ে বিরোধী দলে অবস্থান ও তারেক রহমানকে দলের পদ থেকে সরানো।
গত সপ্তাহে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নতুন দুই শর্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে তিনি বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সুস্পস্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দল। সরকারকেও কিছু জানাতে পারেননি তিনি। এ কারণেই গত বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিন নেতার নির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়। পরে খালেদা জিয়ার বোন সেলিনা ইসলাম সাক্ষাৎ চাইলেও তাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
গত শুক্রবার সকালে শর্ত নিয়ে বিএনপি মহাসচিব কথা বলেছেন খালেদা জিয়ার ছোটভাই শামীম ইস্কান্দারের সঙ্গে। শামীম ইস্কান্দার বোনের মুক্তির জন্য যেকোনো শর্তে রাজি। তিনি ফখরুল ইসলামকে বলেছেন, দলের নেতাদের বোঝাতে। আর তিনি বোনকে (খালেদা) বোঝাবেন। বিষয়টি নিয়ে শামীম ইস্কান্দার দুয়েকদিনের মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তবে ৩৫ বছরের আপসহীন নেত্রী শেষ পর্যন্ত এসব প্রস্তাবে রাজি হবেন কি না এ নিয়ে স্বজনদেরও সন্দেহ রয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, যদি ধারা-৭ পুনর্বহাল হয় সেক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ যারা সাজাপ্রাপ্ত তাদের আর নিজ উদ্যোগে সরে যাওয়ার দরকার নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তারা দলের নেতৃত্ব হারাবেন। তবে আমি জানি না এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে কি না।
এদিকে দুই শর্ত নিয়ে বিএনপিতে স্পস্ট বিভক্তি দেখা দিয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম মনে করেন, বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে কিছুতেই আলাদা করা যাবে না। তবে খালেদা জিয়াকে জেল থেকে বের করার এটি একটি কৌশলগত অবস্থান। অন্যদিকে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পক্ষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র্র রায়, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির খোকন, মোয়াজ্জেম হোসেন আলালরা। খোকন বলেন, শর্ত মানলে তা হবে আত্মসমর্পণ বা আত্মহত্যার শামিল। সরকার একের পর এক শর্ত দিয়ে যাচ্ছে। এসব মেনে নির্বাচন করলে বিএনপির অস্তিত্বই থাকবে না। তারা এই গোপন সমঝোতা বাদ দিয়ে প্রকাশ্য আন্দোলনের ওপর জোর দিচ্ছেন।