• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
কওমি স্বীকৃতি : দূরদর্শী না অপরিণামদর্শী

ড. আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধরী, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা মাসউদ, ড. কলিমুল্লাহ

ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতি

কওমি স্বীকৃতি : দূরদর্শী না অপরিণামদর্শী

  • মিরাজ রহমান
  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০১৮

কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তরের (ইসলামিক শিক্ষা ও আরবি) সমমান স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস হয়েছে। এর শোকরিয়াস্বরূপ ‘হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে ৪ নভেম্বর রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত শোকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া এই স্বীকৃতিটি কি কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ, নাকি একটি অপরিণামদর্শী চিন্তা? এ বিষয়টি এখন টক অব দ্য টাউন। এ নিয়ে বিভেদ রয়েছে শিক্ষাবিদসহ সুশীল সমাজের কারো কারো মধ্যে। সাধারণ শিক্ষিতদের পাশাপাশি এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আলেমসমাজের মধ্যেও বিভেদ বা ভিন্ন মতামত লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আবার কারো কারো মতামত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা বলছেন, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে অপরিণামদর্শী একটি মতাদর্শকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে, যা কখনোই ঠিক নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের খবরের কাছে নিজ নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সমাজের অগ্রসর চিন্তার বরেণ্য কয়েকজন ব্যক্তিত্ব :

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, প্রথম যখন কওমি মাদরাসা সনদকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি আলোচনায় আসে, আমি তখনই বলেছিলাম, আমার কাছে এদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সমমানের মনে হয় না। সুতরাং এদের স্নাতকোত্তরের সমমান প্রদান করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, সরকার কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। সরকারের কাছে হয়তো আমার চেয়ে আরো ভালো ও বেশি তথ্য আছে বলেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রবীণ শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে কখনো রাজনীতি আনা উচিত নয়। শিক্ষাক্ষেত্র চলবে শিক্ষাক্ষেত্রের মতো করে। কওমি মাদরাসা একটি ভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সমতা-বিধান করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ধাপে ধাপে উপরের ক্লাসে উঠতে হয়। এখানে ইংরেজি, বাংলাসহ বিভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। এগুলো তো কওমি মাদরাসায় নেই। সুতরাং কওমি শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি সাধারণ মাস্টার্স ডিগ্রি ও কওমি শিক্ষা— উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে। কারণ কওমি শিক্ষাটি একেবারেই বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা। সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে হচ্ছে।

মাওলানা আশরাফ আলী

হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, এটা সরকারের রজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি-না বলতে পারব না। তবে অতীতে কোনো সরকারই কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কওমি সনদকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অসাধ্য সাধন করেছেন। কওমি শিক্ষার্থীদের উপকার করেছেন। তিনি বলেন, কেউ যখন কারো উপকার করেন তখন তার শোকরিয়া জ্ঞাপন কোরআন-হাদিসের দিকনির্দেশনা। সুতরাং আমরা কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোকরিয়া জ্ঞাপন করেছি। নিম্নস্তরের স্বীকৃতি না নিয়ে একেবারে সর্বোচ্চ স্তরের স্বীকৃতি প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তো কেবল শুরু মাত্র। এখন আমরা আলোচনা করব এবং প্রয়োজনীয় ও উপকারী সিদ্ধান্ত নেব।

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

জাতীয় দ্বীনি শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের গ্রান্ড ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, দেশের জনগণের একটি বড় অংশ কওমি মাদরাসার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের দীর্ঘদিনের  প্রত্যাশা ও দাবি ছিল এই স্বীকৃতি। তিনি বলেন, সরকার দেশের নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য করতে পারে না। আর তাই এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সরকার তার দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তকে কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে হবে না। মাওলানা মাসঊদ বলেন, সরকারের সঙ্গে আলেমসমাজের সম্পর্ক নতুন নয়। সরকারি স্বীকৃতি এলেই যে কারো স্বাধীনতা বা স্বকীয়তা শেষ হয়ে যাবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রচলন না থাকায় কারো কারো কাছে শুধু দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি খটকা লাগছে। তবে ফ্রান্সসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন নজির রয়েছে। প্রতিটি কওমি মাদরাসা কোনো না কোনো বোর্ডের আওতায় নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির তত্ত্বাবধান হয় এবং নিচের শ্রেণিগুলোতে যারা ভালোভাবে পাস করেন, তারাই মাস্টার্স সমমান প্রাপ্ত দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন।

ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদানের সরকারি স্বীকৃতি যথার্থ। কওমি শিক্ষার্থীরা এদেশের নাগরিক। মানবসম্পদের একটি বৃহৎ অংশকে বাদ দিয়ে বা অবমূল্যায়িত রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং দেশের উন্নয়ন বিবেচনায় এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উভয় পক্ষই লাভবান হবেন। এর মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে তথাকথিত পিছিয়ে থাকা আলেমসমাজের সম্পর্ক তৈরি হলো। এই সম্পর্ক আলেমসমাজের নিজস্ব স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষায় অন্তরায় হবে এমনটা ভাবা ঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads