• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮

রাজনীতি

ভোটে নেতাদের রঙ পাল্টাচ্ছে

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বদলে যাচ্ছে রাজনীতির চিরচেনা দৃশ্যপট। রাজনীতির ময়দানে এতদিন যাকে ‘নৌকা’র প্রার্থী হিসেবে দেখা গেছে সেই তিনিই এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ‘ধানের শীষ’, আর ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থী ‘কুলা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে পাল্টে যাচ্ছে সব হিসাব। হঠাৎ করে রাজনীতিতে এই পল্টি খাওয়া নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে হেভিওয়েট প্রার্থীদের এই রকমফেরে ভোটাররা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন। এক কথায় নির্বাচনের আগেই প্রার্থী নিয়ে দেশে যে চমকের সৃষ্টি হয়েছে, এর কোনো ব্যাখ্যাই এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারছেন না। সবাই বলছেন, চোখ-কান খোলা রাখতে। সামনে আরো চমক আসছে। তবে অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতালোভী চরিত্রকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্যই মনোনয়ন মৌসুমে এসে রাজনীতিবিদরা ডিগবাজি দিচ্ছেন। তারা এও বলেছেন, দলবদল একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু ভোটের আগে নৌকার লোক ধানের শীষে, ধানের শীষের লোক কুলা প্রতীকে ছুটে যাওয়া নতুন রহস্য। এতে রাজনীতির চিরচেনা দৃশ্যপটই পাল্টে যাচ্ছে।

তবে গতকাল ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুই এক দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগের এবং এক সপ্তাহের মধ্যে শরিক দলের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। এ জন্য কাজ চলছে। ভালো প্রার্থী পেলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বেশ কয়েকজন নেতা নৌকা প্রতীকের পরিবর্তে ধানের শীষ নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ায় এমনিতেই ভোটের ময়দানে চমকের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া চন্দনাইশে কর্নেল অলির আসনে সুব্রত চৌধুরীর মনোনয়ন নিয়েও লড়াই চলছে। মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সুকুমার রঞ্জন ঘোষের আসনে মাহী বি চৌধুরী মহাজোট থেকে নির্বাচন করতে চাওয়ায় সেখানেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। মেজর মাসুদ উদ্দিন ভূঁইয়া নৌকার প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন কিনেছিলেন। কিন্তু প্রার্থী হতে পারবেন না জেনে চলে যান জাতীয় পার্টিতে। সেখানে অতিদ্রুত পেয়ে যান পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ। হন এইচএম এরশাদের সামরিক উপদেষ্টা। পাশাপাশি ফেনী থেকে নির্বাচন করার জন্য তিনি জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন  কেনেন। ফেনীতেই প্রয়াত জহুর হোসেন চৌধুরীর ছেলে সাঈদ হোসেন চৌধুরী ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করতে চান। আর ঢাকায় তার ভাই সাবের হোসেন চৌধুরী আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করছেন।  এ ছাড়া চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও বিএনপির সাবেক নেতা মনজুর আলম সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন কিনেছেন। তিনি বিএনপির হয়ে চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবার সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হওয়ার জন্য গণফোরামে যোগ দিয়েছেন। তিনি হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে প্রার্থী হতে চান। এর আগে তিনি নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তিনি গণফোরামে যোগ দেন এবং প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে চান।  তার বাবা শাহ এ এম এস কিবরিয়া ২০০১ সালে হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। রেজা কিবরিয়া ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রার্থী হওয়ায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০১৪, ২০০৮ সালেও তিনি এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। আর এবার না পেয়ে সোজা গণফোরামে। রেজা যে আসনে প্রার্থী হতে চান, সেই হবিগঞ্জ-১ থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বিএনপি নেতা শেখ সুজাত মিয়া এবারো ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন। কিবরিয়াপুত্রের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাননি জানিয়ে সুজাত বলেন, ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করার জন্য যে কেউ মনোনয়ন কিনতে পারেন। এতে আমার বলার কিছু নেই। ড. রেজা কিবরিয়া ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হলে আপনি কি মহাজোট তথা আওয়ামী লীগে ভিড়বেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রয়োজনে আমি স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করব। তবু নৌকা বা লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করব না।

সিলেট-৬ আসনটি (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আসন। এতদিন ওই আসনে আওয়ামী লীগ তথা জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনিই নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু শুক্রবার থেকে ওই আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ভোটের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শমসের মবিন চৌধুরীর নাম। জানা গেছে, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপি নেতা ২০১৪ সালের দিকে রাজনৈতিক কারণে কারাভোগের পর রাজনীতি ছেড়ে দেন। কিন্তু মাসখানেক আগে তিনি হঠাৎ করেই বিকল্পধারায় যোগ দেন। এরপর বিকল্পধারার প্রেসিডিয়াম মেম্বারও হন। যুক্তফ্রন্টের একজন হয়ে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ শুরু হওয়ার আগে কিছু সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে আলাদা কথা বলেন। এরপর থেকেই ময়দানে কথার রঙ ছড়াতে থাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল সিলেট-৬ আসনে শমসের মবিন চৌধুরীর প্রার্থিতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তবে এই আসনে শমসের মবিন চৌধুরীর প্রার্থিতার খবর শুনে বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগ গত বুধবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর দলীয় প্যাডে লিখিতভাবে অনুরোধ করে চিঠিতে বলেছেন তারা আগামী নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে শিক্ষামন্ত্রীকে বিজয়ী করারও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা আরো উল্লেখ করেছেন, শিক্ষামন্ত্রীর আচরণ ও উন্নয়নে দলীয় নেতাকর্মী এবং এলাকার সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট। এ অবস্থায় গুটিকয়েক ব্যক্তির হিংসাত্মক মনোভাব ও নানামুখী ষড়যন্ত্রে ভুল না বুঝে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর প্রাণের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলীয় মনোনয়ন বোর্ড এতদঞ্চলের গণমানুষের প্রিয় নেতা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপিকে পুনরায় মনোনয়ন দেবেন বলেও তাদের শতভাগ বিশ্বাস রয়েছে।

জানতে চাইলে শমসের মবিন চৌধুরী গতকাল শনিবার বাংলাদেশের খবরকে জানান, কিছুদিন লাইনচ্যুত হয়েছিলাম। এখন আবার লাইনে চলে এসেছি। আপনি কি সিলেট-৬ থেকে নির্বাচন করছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি সেখান থেকেই নির্বাচন করছি। এতে কি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করছি কোনো ঝামেলা হবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন না যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে বিকল্পধারায় যোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে যুক্তফ্রন্টই বলেন আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট যেটাই হোক না কেন আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।

মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-জুড়ীর একাংশ) আসন এর আগে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। আর ধানের শীষে একবার এবং স্বতন্ত্র একবার নির্বাচন করেছেন এমএম শাহীন। কিন্তু এবারের ভোটে আগের সবকিছু পাল্টে গেছে। নৌকার সুলতান চলে গেছে ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষে। আর ধানের শীষের শাহীন চলে এসেছেন বিকল্পধারার কুলায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নৌকার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কুলা নির্বাচন করবে। এর ফলে কুলার প্রার্থীই নৌকার প্রার্থী হয়ে যাবেন, যা কুলাউড়া তথা মৌলভীবাজারে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সিলেট সদর আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অথবা তার ভাই ড. একে মোমেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন। এর বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রার্থী হচ্ছেন প্রাইভেটাইজেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী। এর ফলে সেখানেও চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads