• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সিদ্ধান্ত অনেক, বাস্তবায়ন শূন্য

লোগো বিএনপি

রাজনীতি

সিদ্ধান্ত অনেক, বাস্তবায়ন শূন্য

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০১৯

দলের স্বার্থে গত তিন বছরে অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল কখনো দলীয় প্রধানের একক, সিনিয়র নেতাদের যৌথ সভা কিংবা সারা দেশের নেতাদের সমন্বয়ে কাউন্সিল করে। হাতেগোনা কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নের ঝুড়িতে শূন্য বিরাজ করছে। এ ব্যর্থতার জন্য খোদ দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাদের দায়ী করা হচ্ছে। একের ব্যর্থতার দায় অন্যের কাঁধে চাপানোর প্রবণতাও বেড়ে গেছে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলটিতে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিতে এখন ভাটা চলছে। আর ভাটার টানে পড়লে রাজনৈতিক দল ও দলীয় নেতাদের চিত্র এমনটিই হয়। তবে ক্ষমতার বাতাস বা সুবিধা রেখা দেখা দিলে তা কেটে যায়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে দূরে ছিল; কিন্তু এমন করুণ চিত্র দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী। বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি দক্ষ কাণ্ডারির অভাব বোধ করেন। একই সঙ্গে বলেন, চাপানো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন। সিদ্ধান্ত নিতে হবে সময়োপযোগী। তবেই বাস্তবায়ন সম্ভব।

তবে দলের ভাটার কথা মানতে নারাজ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন- গায়েবি মামলা, শীর্ষ নেতার বন্দিদশার পরও বিএনপি অটুট ও ভালো আছে।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হলেও সব পদ পূরণ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি দলটি। এই সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে তো পারেইনি বরং শীর্ষ নেত্রীর সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়ায় এবং একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অভাবিত ফলে আরো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে বিএনপি।

কাউন্সিলের মেয়াদ পূর্ণ করলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিএনপি। কাউন্সিলে দলকে শক্তিশালী করতে এক নেতার এক পদের বিধান রেখে খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ২৬টি উপ-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। দলের সদস্য ফি ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা, মাসিক চাঁদা ৬ মাস না দিলে পদ স্থগিত, এক বছর না দিলে পদ বাতিল, টানা দুই বছর চাঁদা না দিলে তার প্রাথমিক সদস্য পদ স্থগিত, তিন বছর না দিলে প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় কাউন্সিলে। এছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নেওয়া হয় নানামুখী পদক্ষেপ। অঙ্গ দলগুলোকে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

কাউন্সিলের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউন্সিলের পরে ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের ৭৩ জন সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। শুরুতে স্থায়ী কমিটির দুটি পদ খালি থাকলেও পরে তিন সদস্যের মৃত্যুতে নীতিনির্ধারণী ফোরামের ৫টি পদ শূন্য হয়। ছাত্র ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও যুববিষয়ক সম্পাদক পূর্ণ মেয়াদে ঠিক করতে পারেনি। নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার পরও এক নেতার এক পদের বিধান কার্যকর করতে পারেনি বিএনপি। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৬১ নেতা একাধিক পদ ধরে রেখেছিলেন। ‘এক নেতার এক পদ’ বিধানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ৩০ জন নেতা একাধিক পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু বাকি পদের অনেকেই এই বিধানের প্রতি সম্মান দেখাননি।

কাউন্সিলে বিষয়ভিত্তিক অর্থ ও পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা, শিল্প ও বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, নারী ও শিশু, যুব উন্নয়ন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ, যোগাযোগ ও গণপরিবহন, এনার্জি ও খনিজসম্পদ, মানবাধিকার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মুক্তিযুদ্ধ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণ, সুশাসন ও জনপ্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জাতীয় সংহতি ও এথনিক মাইনরিটি নামে ২৬টি উপকমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল। এক একটি কমিটিতে ১২ সদস্য রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই কমিটি গঠন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে দেশের সাংগঠনিক সব জেলা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ হয়েছে। কিন্তু শতভাগ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও এক নেতা একাধিক পদে থাকার আগ্রহের কারণে কমিটি গঠনে নানা সমস্যাও হয়েছে। এছাড়া গত তিন বছরে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠন হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আংশিক কমিটি দিয়েই চলছে। কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার জন্য যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে সুপার ফাইভ বা সুপার সেভেনের নেতারা তেমন কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছেন না। ফলে বেঁধে দেওয়া সময় পার হওয়ার পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হচ্ছে না।

কাউন্সিলের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর বিএনপির কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, পদ নেওয়ার ব্যাপারে নেতারা যতটা আন্তরিকভাবে কাজ করে। পদের যে কাজ তা যদি আন্তরিকভাবে করত তাহলে হয়তো কাউন্সিলে নেওয়া সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতো। এছাড়া এক বছরের বেশি সময় ধরে দলীয় চেয়ারপারসন কারাগারে থাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের গতি মন্থর হয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে চেয়ারপারসনকে কমিটি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কাউন্সিলররা। তার প্রায় পুরোটাই দলীয় প্রধান করেছেন। কিন্তু এরপর এক পদের বিধান কার্যকর করাসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল তা দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি করতেন তাহলে সাংগঠনিকভাবে কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়া যেত।

দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করায় কাউন্সিলের পর পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সে সময় জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে আবার বিএনপি ‘ফিনিক্স পাখি’র মতোই ঘুরে দাঁড়াবে বলে ঘোষণা দেন মহাসচিব। আর কাউন্সিলের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর গত ১৯ মার্চ তিন বছরে বিএনপির কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, কাউন্সিল হওয়ার পর দল সংগঠিত হয়েছে। যেসব কর্মসূচি ছিল পালন করেছে। নির্বাচনের মতো একটা বিশাল কর্মকাণ্ডে দল অংশ নিয়েছে। প্রতিকূলতা ভয়াবহ ছিল। এই সময়ের মধ্যে দলের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়াকে বেআইনি ও অন্যায়ভাবে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গায়েবি মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এরপরও বিএনপি এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবেই আছে। অটুট ও ভালো আছে। কাউন্সিলের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে বলেও দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। এক নেতার এক পদের বিধান কার্যকর করাসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ছোটখাটো বিষয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, কাউন্সিলের পর গত তিন বছরে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে বিএনপি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads