• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জিয়া থেকে যোজন দূরে বিএনপি

ফাইল ছবি

রাজনীতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদের মূল্যায়ন

জিয়া থেকে যোজন দূরে বিএনপি

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ০৪ জুন ২০১৯

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে বিরোধী দলের আসনে অনুকূল পরিবেশও পেয়েছে। তবে গত ১০ বছর শুধুই রাজপথে। দলটি ইতোমধ্যে স্মরণকালের নানামুখী প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। সংকটের পাহাড় ঘিরে আছে দলটির মধ্যে। জিয়ার গড়া ১৯ দফার অনেক দফাই এখন বিলুপ্ত। তার তৈরি দলীয় গঠনতন্ত্রেও চালানো হয়েছে কাঁচি। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদদের মূল্যায়নে গত দুই যুগে অসংখ্যা ভুল সিদ্ধান্ত, দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দি হওয়া এবং দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থানের ঘটনায় দলটিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওলটপালট হয়েছে ডান-বামের সমন্বয়ে গড়া জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয় দল বিএনপি। লক্ষ্যভ্রষ্ট, পথভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট, আদর্শ আর চেনতনাহীন হয়ে পড়েছেন দলটির নেতারা। দুর্নীতি, অপশাসন, বিলাসিতা, স্বজনপ্রীতির সঙ্গে অপরিচিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ব্যক্তি দর্শন আর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে আজকের বিএনপি।

খোদ বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাবনায় আদর্শচ্যুত ও দুর্বল নেতৃত্বের কারণে জিয়া পরিবারসহ দলের কোটি কোটি নেতাকর্মী-সমর্থক চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান শুধু নেতাদের বহিরঙ্গে আছেন কিন্তু অন্তরে নাই। তাই দলের এই করুণ দশা। উত্তরণের জন্য জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে দাবি উঠেছে দলের তরফ থেকেই। বিএনপির শীর্ষ নেতারা ইতোমধ্যে দলীয় ফোরাম কিংবা সভা-সমাবেশে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। আর মধ্যম ও শেষ সারির নেতাকর্মীরা তাদের ক্ষোভ, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে নানামুখী মন্তব্য ও পরামর্শ দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বা কর্মকর্তারা নিজেদেরকেই নীতিভ্রষ্ট,পথভ্রষ্ট, সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ ও কলুষিত হূদয়ের- এ কথা স্বীকারে কুণ্ঠাবোধ করছেন না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দেশে সংস্কৃতি ও রাজনীতির নামে ভয়ংকর অপসংস্কৃতি ও অপরাজনীতি চলছে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতির নামে যা করছে তাতে দেশের মানুষ তাদের থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতি ছিল মানুষের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে; কিন্তু এখন রাজনীতিবিদরা স্বার্থপর হয়ে গেছেন। শূন্য দিয়ে শুরু করে তারা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই রাজনৈতিক দলই মানুষকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছে তা পূরণ করতে পারছে না।

বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গে এই রাজনীতিক বিশ্লেষকের মন্তব্য, জিয়াউর রহমান নিজের ব্যবহূত প্যান্ট, শার্ট কেটে তার সন্তানদের জামা-কাপড় বানাতেন, বেতনের একটি অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতেন। তার বিচরণ ছিল ছিন্নমূল সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। দুর্নীতি, লোপাট বা স্বজনপ্রীতি শব্দের সঙ্গে তিনি অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দেখছি দলটিতে জিয়ার আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। তৎকালীন ছাত্র-শ্রমিক নেতারা আজ শিল্পপতি। যার কারণে দলটিও সংকটে পড়েছে। তবে ক্ষয়িষ্ণু সমাজে বিএনপিকে জিয়ার আদর্শে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন দিলারা চৌধুরী।

মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ও অন্যতম থিংকট্যাংক। সংকটকালে পরামর্শ দিয়েছেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। তার মূল্যায়ন জিয়াউর রহমানের সেই বিএনপি আর এই বিএনপির মধ্যে অনেক ফারাক দেখছেন।

তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জিয়া সামরিক লোক ছিলেন কিন্তু দলে তিনি গণতন্ত্র চর্চা করতেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দল চালাতেন, রাষ্ট্রও চালাতেন। তার দলের জন্য তৈরি গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে। বিএনপি সেটি ভুলে মনোনয়নতন্ত্র শুরু করেছে। ফলে তদবির,স্বজনপ্রীতি ও বাণিজ্যনীতি দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে। আজকে দলে যে সংকট চলছে সেজন্য জিয়ারতন্ত্র ফলো করে জরুরি সভা ডেকে তা উত্তরণ ঘটাতে পারে। বহির্বিশ্বে বিএনপি এখন বন্ধুহীন তার নেপথ্যেও জিয়ার আদর্শ ও পররাষ্ট্রনীতিকে ফলো না করা। জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির কারণে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব, প্রীতি ও সমতা রক্ষা করা। সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে, তৃতীয় বিশ্বের মিত্র রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে এবং ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রীতি ও সখ্যের সম্পর্ক সুসংহত এবং সুদৃঢ করা ছিল তার লক্ষ্য। সোজা কথা বিএনপি ভুল পথে হেটে নিজের সংকট নিজেই ডেকে এনেছে। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি তার লেখা চিঠির কথা উল্লেখ করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, চিঠির আলোকে ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্ত নিলেও আজ খালেদা জিয়াকে কারাবাস করতে হতো না।   

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত ৭৮ সদস্যের কমিটিতে তিনি ছিলেন ১৪ নম্বর সদস্য। দল ত্যাগ করেছেন, আবার ফিরেছেন দলে। বিএনপির চড়াই-উতরাই সবই দেখেছেন। গত ২৯ মে রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৩৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছি বলে মনে হয়। তিনি একজন মিত্যব্যয়ী ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না এবং তিনি যে রাজনীতি দিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে উদার, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল একটা রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তার ১৯ দফার মধ্যে ছিল সার্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শিক মূল কাঠামো। যত শিগগিরই সম্ভব উচিত হবে সেই দর্শনের কাছে থাকা এবং তার থেকে দূরে সরে না যাওয়া।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেলা পর্যায়ের রাজনীতিবিদ থেকে এখন বিএনপির মহাসচিব। দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে তিনিই শীর্ষ নেতা। তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমান ইজ জিয়াউর রহমান। তিনি ছিলেন সততার প্রতীক। এখন আমরা শুনি বিদেশে সম্পদ জমা হচ্ছে পাহাড়ের মতো। অনেকের ৪/৫টা করে বাড়িঘর হচ্ছে এই ঢাকা শহরে। দুর্নীতির পাহাড় গড়েছে, একেকজন পকেট ভারী করেছে। আমি বলব— আমাদের জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও দর্শনকে অনুসরণ করতে হবে। বিএনপিকে টিকিয়ে রাখা, জাতিকে টিকিয়ে রাখার মূল মন্ত্র হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সুতরাং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করা আমাদের জন্য সুইসাইডেল হবে।

দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। বিএনপির খাতায় তার নাম না থাকলেও দীর্ঘ সময় দলটির সঙ্গে ওঠাবসা তার। গত ৩০ মে সাংবাদিক মারুফ কামাল খান তার ফেসবুকে দলীয় নেতাকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাধুভাষায় স্বল্প লিখেছেন।

তার লেখা হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘তাঁহার নাম জপিয়া, নাম বেচিয়া অনেক দিন ধরিয়া আমরা অনেকেই নানাবিধ ফায়দা লুটিয়াছি। কিন্তু জীবনাচরণে, চরিত্রে, কথায়-কাজে, সাহসে, শৌর্য্যে,বীরত্বে, সততায়, দেশপ্রেমে, আন্তরিকতায়, প্রজ্ঞায়, দূরদর্শিতায়, ব্যক্তিত্বে, কর্মনিষ্ঠায়, ত্যাগে, শ্রমে তাঁহার সত্যিকারের অনুসারী বর্তমানে কতজন অবশিষ্ট রহিয়াছে?

আমরা তাঁহার নামে চেঁচাইয়া জয়ধ্বনি দেই, তাঁহার ছবি প্রচারপত্রে উৎকীর্ণ করি ও নিজেদের গাত্রে লটকাইয়া রাখি কিন্তু তাঁহার জীবনাদর্শ নিজেদের জীবনে কি আমরা ধারণ করিয়াছি? আমরা সুসময়ে আড়ম্বর ও বিলাসের স্রোতে গা ভাসাই। দুঃসময়ে একে অপরের ছিদ্রান্বেষণ এবং কনুইয়ের গুঁতায় সকলকে হটাইয়া নিজেকে জাহির করিতে ব্যস্ত থাকি। এমন সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ ও কলুষিত হূদয়ে তাঁহার স্থান কোথায়? জিয়াউর রহমান শুধু আমাদের বহিরঙ্গে আছেন কিন্তু অন্তরে নাই। তাই আমাদের এই করুণ দশা। তাই আমরা অনুকূল পরিস্থিতিতে মজা লুটিতে পারদর্শী হইলেও দুর্দিন মোকাবিলার সাধ্য-সামর্থ্য হারাইয়া ফেলিয়াছি। শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা জানাইবার অধিকার আমাদের মতন এই পথভ্রষ্টদের আছে কি?’

বিএনপির বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, রাজনীতি করতে গেলে রাজনীতির আইডলের আদর্শ ঈমানের সঙ্গে ধারণ করতে হয়, আদর্শকে সম্পদ হিসেবে লালন করতে হয়। নিঃসন্দেহে আমরা কিছুটা হলেও প্রেসিডেন্ট জিয়া থেকে দূরে সরে গেছি। জিয়াউর রহমান যে লক্ষ্য নিয়ে দল গঠন করেছিলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার সময় যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং যেসব বিষয়কে বর্জন করতেন বিএনপি শুধু জিয়াকে ফলো করলেই বহির্বিশ্বে বন্ধু এবং দেশে জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখতে পারত।

তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের ব্যক্তি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনৈতিক দর্শন ও দৃঢ়তাকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলেই বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি মিলবে বলে মনে করেন সাবেক এই ছাত্রদল নেতা।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads