• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সংগৃহীত ছবি

রাজনীতি

‘আমার পার্টি’র মহাসচিব  যেভাবে আসেন-যান

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ১৯ জুন ২০১৯

ঘনঘন মহাসচিব বদল হয় সাবেক সেনাপ্রধানের ‘আমার পার্টি’তে। প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরে ওই চেয়ারে ওঠাবসা করেছেন ডজনখানেক ব্যক্তি। কায়দা-কৌশল করে যেভাবে পার্টির মহাসচিবের চেয়ারের নাগাল পেয়েছেন, চেয়ারচ্যুত হয়েছেন সেভাবেই। কেউ ছিলেন ক্ষণস্থায়ী, কেউ দীর্ঘ মেয়াদে। তবে যিনি যত স্থায়ী হয়েছেন তার বিরুদ্ধে তত কেলেঙ্কারির ঘটনা রয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা, মনোনয়ন-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দলীয় তহবিল তছরুপ থেকে শুরু করে অসংখ্য অভিযোগ উঠেছিল পার্টির প্রায় সব মহাসচিবের বিরুদ্ধেই। খোদ পার্টি মালিকের বিরুদ্ধেও আছে নানামুখী সমালোচনা। উত্থাপিত অভিযোগের বিচার তো দূরের কথা, লোক দেখানো কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। এ চিত্র আদালতের অবৈধখ্যাত সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির। ওই পার্টিকে এরশাদ নিজেই ‘আমার পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এই পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। মূল পার্টি জাতীয় পার্টি দফায় দফায় বিভক্ত হয়ে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এই পার্টিতে রূপ নেয়। পার্টিটির মূল নেতা এরশাদ। বর্তমানে পার্টিটি ৪টি অংশে বিভক্ত। জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), জাতীয় পার্টি নাজিউর রহমান মঞ্জু ও জাতীয় পার্টি (জাফর)।

এরশাদের জাতীয় পার্টিতে বর্তমান মহাসচিব পরিবহন শ্রমিক নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি। তিনি গত সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার আগে মহাসচিব ছিলেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। বর্তমান মহাসচিবের বিরুদ্ধে মনোনয়ন-বাণিজ্যসহ ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন দলটির মহিলা এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপিকা মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার হাওলাদারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন পটুয়াখালীর জনৈক নারী। এর আগে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগে তৎকালীন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় জিয়া উদ্দিন বাবলুকে। রকেট গতিতে যেভাবে হাওলাদারকে সরিয়ে বাবলুকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার চেয়েও বেশি দ্রুত গতিতে হাওলাদারের প্রত্যাবর্তন ঘটে ওই পদে। ১৯৮৬ সালে দল গঠনের পর থেকে এভাবেই মহাসচিব বদল হচ্ছে এইচ এম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে।

হিসাব করলে দেখা যায়, রাঙ্গার আগ পর্যন্ত এই ৩৩ বছরে ডজনখানেক মহাসচিব পেয়েছে জাতীয় পার্টি। তাদের আসা-যাওয়া কোনো কাউন্সিল বা সম্মেলনে হয়নি, সব হয়েছে চেয়ারম্যান এরশাদের ইচ্ছায়। সামরিক শাসক থেকে রাজনৈতিক দল গড়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এরশাদ ‘স্বৈরাচারী’ কায়দায়ই দল চালিয়ে আসছেন বলে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতাদের অভিযোগ। বাবলুকে সরানো এবং ভাই জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে বিরাজমান দ্বন্দ্বের মধ্যেও এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘এটা আমার পার্টি’। দলটির গঠনতন্ত্রেও গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ নেই।

এরশাদের এই দলটির মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে মহাসচিব নির্বাচনের ক্ষমতা দলের চেয়ারম্যানকে দেওয়া রয়েছে। সেই অনুযায়ী প্রতিবার তিনি যাকে খুশি তাকেই মহাসচিব মনোনীত করেছেন। কোনোবারই কাউন্সিলের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে কাউকে মহাসচিব করা হয়নি।

দলটির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বাংলাদেশের খবরকে জানান, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠনের পর এর প্রথম মহাসচিব হন ডা. এমএ মতিন। জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সাত্তারের সরকারের এই মন্ত্রী জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে তিন বছর ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হয়ে সফল না হয়ে ইস্তফা দেন ডা. এমএ মতিন। তার পদে আসেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান, যিনি এর আগে এরশাদ ঘোষিত ১৮ দফা বাস্তবায়ন পরিষদের মহাসচিব ছিলেন। জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে ফিরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় নোয়াখালীর চাটখিলের সাবেক এই সংসদ সদস্য। এখন ফের জাতীয় পার্টিতে চলে গেছেন তিনি। মাহবুব অল্প কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর টাঙ্গাইলের মাহমুদুল হাসানকে মহাসচিব করেন এরশাদ। ব্যাপকমাত্রার দুর্নীতির অভিযোগ ছিল সাবেক এই মেজর জেনারেলের বিরুদ্ধে। ‘থিফ অব বাগদাদ’খ্যাত এই ‘রাজনীতিবিদ’ এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। ১৯৯০ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে এরশাদ সেনা কর্মকর্তা মাহমুদুলকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হয়ে আসা শাহ মোয়াজ্জেমকে বসান মহাসচিব পদে।

কিন্তু ওই গণআন্দোলনে পতন ঘটে এরশাদের, কারাগারেও যেতে হয় তাকে। এর মধ্যেই ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মহাসচিব পদে ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ দেখিয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে বিএনপিতে ফিরে যান শাহ মোয়াজ্জেম, এখনো দলটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন তিনি। জাতীয় পার্টি যারা গঠন করেছিল, তিনি তাদের একজন। এরশাদ বন্দি থাকা অবস্থায় শাহ মোয়াজ্জেমকে সরিয়ে যশোরের খালেদুর রহমান টিটোকে মহাসচিব করেন। তিনি এই পদে দুই বছরও টেকেননি। আওয়ামী লীগ হয়ে এখন তিনি রাজনীতিতে। ১৯৯৫ সালে আবার কারাগার থেকে চিরকুট পাঠিয়ে টিটোকে বাতিল করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব করেন এরশাদ। এর পরের বছর কারামুক্ত হন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এই সামরিক শাসক। তার আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি, মন্ত্রী হন মঞ্জু। ১৯৯৭ সালে এরশাদ সরকারে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলে তাতে আপত্তি জানান মঞ্জু। তখন মঞ্জুকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে মঞ্জু মন্ত্রী পদে থেকে যাওয়ার পাশাপাশি আলাদা জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। মঞ্জুকে সরানোর পর নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে মহাসচিব পদে বসান এরশাদ। ভোলার এই এমপি এরশাদের আমলে ঢাকার মেয়র ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী থাকার সময় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রায় তিন বছর পর ২০০১ সালে নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর মঞ্জুরকেও বাদ দেন এরশাদ। মঞ্জু’র মতো মঞ্জুরও তখন আলাদা দল গঠন করেন। তাতে সঙ্গী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ডা. মতিনকে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নামে ওই দলটি মঞ্জুরের ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলেন। বিবৃতি দিয়ে জোট ত্যাগ করেছেন। ২০০১ সালে সাবেক জাসদ নেতা বগুড়ার এবিএম শাহজাহানকে মহাসচিবের দায়িত্বে আনেন এরশাদ। দুই বছর পর ২০০৩ সালে এ পদে আসেন বরিশালের রুহুল আমিন হাওলাদার। এরশাদের সব কথা বিনা প্রশ্নে মেনে চলা হাওলাদার টানা ১২ বছর এই দায়িত্বে ছিলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে অংশগ্রহণের পর ২০১৪ সালে হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেন এরশাদ।

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads