• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন প্রতিবারই

ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতি

আটত্রিশ বছরে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা, হামলার পরিকল্পনা অর্ধশত

ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন প্রতিবারই

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ০৪ জুলাই ২০১৯

সর্বদাই হুমকির মুখে শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর থেকে তাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো স্বাধীনতাবিরোধীচক্র, কখনো জামায়াত-বিএনপি জোট, আবার কখনো জঙ্গিরা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে হত্যার চেষ্টা করেছে। হত্যার নীলনকশা করেছে কমপক্ষে অর্ধশতবার। কিন্তু প্রতিবারই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ভেস্তে গেছে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি বেঁচে গেছেন কমপক্ষে ৫ বার। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা নিজের জীবনের মায়া না করে তিনি দেশমাতৃকার টানে পিতার মতোই বীরদর্পে সমস্ত ঝুঁকি-হুমকি মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফেরার পর থেকেই শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু ছোট বোন শেখ রেহানাসহ বিদেশে থাকায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নগ্ন থাবা থেকে রক্ষা পান শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ যখন নেতৃত্বহীনতায় ভুগছিল ঠিক তখনই শেখ হাসিনার অবর্তমানেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের প্রভু আন্তর্জাতিক মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশমাতৃকার টানে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব নেন। দেশে ফেরার পর থেকেই শেখ হাসিনার ওপর একের পর এক হামলা হয়েছে। প্রতিবার তিনি বেঁচে গেলেও তাকে রক্ষায় জীবন দিতে হয়েছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে।

পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার ওপর প্রথম বড় হামলা হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ৮ দলীয় জোটের মিছিলে। এর পরের হামলা ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন বাসভবনে ছিলেন। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় এবং একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি। সূত্রমতে, প্রাণনাশের তৃতীয় চেষ্টা হয় ১৯৯১-এর ১১ সেপ্টেম্বর। টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে বেলা আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি স্কুলে উপনির্বাচনের ভোট দেওয়ার পর তিনি গ্রিনরোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির কর্মীরা গুলিবর্ষণ ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে শুরু করে। এ সময় ২০/২৫ রাউন্ড গুলি ও বোমাবর্ষণ হয়। তিন বছরের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনে প্রবেশের মুখে শেখ হাসিনাকে বহনকারী রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। সোয়া এক বছরের মধ্যে ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় গুলিবর্ষণ করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর। ষষ্ঠ হামলাটি হয় ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে এবং হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল। এই বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা হয় ২০০১ সালের ২৯ মে সিলেটে। ২০০২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরও বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। শেখ হাসিনার ওপর ১৩তম হামলা ঘটে ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার যোগসাজশে দুর্বৃত্তরা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়। স্মরণকালের নারকীয় ওই হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রাণ হারান। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন কমপক্ষে ১০০ জন, আহত হন ৫ শতাধিক।

 

মুফতি হান্নানের ব্যর্থ চেষ্টা ও একজন বদিউজ্জামান

২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে জনসভা করার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। কিন্তু সভাস্থলে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা চালায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান। মুফতি হান্নানের সেই অপচেষ্টা সফল হয়নি স্থানীয় চা দোকানদার বদিউজ্জামান সরদারের কারণে। সেই সভাস্থলের পাশেই ছিল তার দোকান। জনসভার আগের দিন সকালে পুকুরে চায়ের কেটলি ধুতে গিয়ে একটি তার নজরে আসে বদিউজ্জামানের। দ্রুত আশপাশের লোকজনকে সেই তারটি দেখান তিনি। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছুটে আসে। শুরু হয় তল্লাশি। সন্ধান মেলে ৭৬ কেজি ওজনের বোমার।

১৯ বছর পর গত সম্প্রতি উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সোহরাব হোসেন হাওলাদারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন বদিউজ্জামান। এতদিন প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঘটনার নেপথ্য কথা জানতেন না। একঘণ্টা সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী বদিউজ্জামানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এরপর তিনি খুশি হয়ে বদিউজ্জামানের হাতে ৫০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন। ওই সময় বদিউজ্জামান সরদার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দীর্ঘ ১৯ বছর আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউই আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেননি। অবশেষে সোহরাব হোসেন আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেন। প্রধানমন্ত্রী মন খুলে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি আমাকে ৫০ লাখ টাকার অর্থ সহায়তা করেছেন। তার এই মহানুভবতায় আমি খুশি। দোয়া করি আল্লাহ যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন।

 

শ্বাসরুদ্ধকর প্রথম হামলা

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার প্রথম সমাবেশ। মানুষের মধ্যে ছিল তীব্র উত্তেজনা। কারণ চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বৈরাচারবিরোধী সমাবেশ করছেন। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে পুলিশ বাধা দেবে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোনো বাধা তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। হাজার হাজার নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে নিউমার্কেট হয়ে কোর্ট বিল্ডিং যাচ্ছিল শেখ হাসিনার গাড়িবহর। এর মধ্যেই পথে পথে চলছিল বিডিআরের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শেখ হাসিনার গাড়িকে নিরাপদে কোতোয়ালি মোড় পার করে দেওয়ার জন্য দারুল ফজল মার্কেটের সামনে মানববেষ্টনী তৈরি করে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। তাদের দুজন হলেন সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম ও অমল কান্তি দাশ। কৃষ্ণ কুমারী স্কুলের দেয়াল থেকে বিডিআর গুলি চালায়। প্রথম দফা গুলির একটি নিঃশব্দে ওপরের চোয়াল দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে কিছু মগজ নিয়ে বের হয়ে যায়। মাটিতে ঢলে পড়া শামীমকে ধরতে যান অমল দাশ। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটি তার চিবুক হয়ে বাম চোয়ালের একটি অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। অমল জ্ঞান হারালেও সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢরে পড়েন মহিউদ্দিন শামীম। মহিউদ্দিন শামীম বাবাকে হারিয়েছিলেন ছোটবেলায়। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শামীম ছিলেন প্রথম। বাবার মৃত্যুর পর অনেক কষ্টে মা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে একটি চাকরি জোগাড় করেছিলেন। অভাবের সংসার। মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। শামীম সংসারের হাল ধরার সুযোগ পাননি। এ যাত্রায় অল্পের জন্য প্রাণ বাঁচে শেখ হাসিনার।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা গ্রেস জীবন-যাপন করছেন। তিনি ভাগ্যবতী, তাই ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন। এত শতবার হত্যাচেষ্টার পরও তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি ধরেই নিয়েছেন যে কোনো মূহূর্তে মরতে পারি। হ্যাঁ, তিনি আপস করেননি, করবেন না। তিনি দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মোড়লদের চাপ উপেক্ষা করে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তার সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করেছেন এবং সাজা কার্যকর করেছেন। তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন। জঙ্গিরা তাকে বারবার টার্গেট করছে। জঙ্গিদের প্রতিটি টার্গেটের তালিকায় প্রথমেই শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এটা তিনি জানেন। তবে এ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সাফ জবাব, জন্মেছি মরতে তো হবেই। মাথা নত করব কেন? যতদিন বাঁচি মাথা উঁচু করে বাঁচব। নাসিম আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী এখন আর নিজের চাওয়া-পাওয়া, নিজের জীবন নিয়ে ভাবেন না। তিনি এখন বঙ্গবন্ধুর মতো দিনরাত দেশ নিয়ে ভাবেন, দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভাবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads