• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
অগোছালো আ.লীগ

ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতি

অগোছালো আ.লীগ

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগে। অনেক এলাকায় দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চাপা থাকলেও প্রায়ই তা প্রকাশ্য হয়ে পড়ায় ও দ্বন্দ্ব মাঠে গড়ানোর আশঙ্কায় অস্বস্তিতে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল-সর্বত্রই আধিপত্য দখলে প্রকাশ্য অনেকের দ্বন্দ্ব। মূল দল থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও কোন্দলের ছায়া।

একই সঙ্গে ছাত্রলীগের কোন্দল প্রায়ই নেতিবাচক খবরের জন্ম দিচ্ছে। দ্বন্দ্বের কারণেই তৃণমূলের কমিটি পাচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব, ঘোষণা দিলেও কোনো কোনো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পূর্ণ হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, টানা সাড়ে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে দেশের নানা উন্নয়নে সফল হলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলের ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা।

দলীয় সূত্র জানায়, টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়গুলো বড় ইস্যু হয়ে সামনে আসায় দলে কোন্দল বেড়েছে। সে কারণে দলটির ভেতরে অনেক ‘উপদল’ ও ‘গোষ্ঠী’ জন্ম নেয় বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকে বলেন। উপদল ও গোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন সময় গড়ালে সরকার ও আওয়ামী লীগও বিব্রত হয়। বিভিন্ন এলাকায় দলীয় কার্যক্রম সীমিত বা নামকাওয়াস্তের হয়ে পড়ছে শুধু নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্বের কারণে। দলের ভেতরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে সহিংসতাও হয়। দলের নেতাকর্মীর রক্তে রাজনীতির মাঠ রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষোভের বিষয়ও সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র জানায়, টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকারে থাকার ফলে দলের বিভিন্ন স্তরে ‘আমি কী পেলাম আর কী পেতে পারি’-এই প্রশ্ন মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফলে দ্বন্দ্ব বহুমুখী রূপ নিয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পেছনে মোটা দাগে আরো যেসব কারণ চিহ্নিত করা যায়, সেগুলোর মধ্যে আছে, জাতীয় বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ, আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ঠিকাদারি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ, পদ-পদবি লাভ এবং প্রাপ্ত পদ-পদবি ধরে রাখার মানসিকতা। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কয়েক নেতারও নিজের সংসদীয় বা নির্বাচনী এলাকায় আলাদা ‘উপদল’ আছে। কেউ কেউ দলের বড় অংশ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন উপদল নিয়ে। কয়েক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আছে। মন্ত্রিসভার কয়েক সদস্যও এমন অভিযোগে অভিযুক্ত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বাংলাদেশের খবরকে এসব প্রসঙ্গে বলেন, ‘দিনে দিনে দলে কোন্দল জটিল পরিস্থিতি ধারণ করার কারণ জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া। এমনকি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলে কোন্দল অনেক এলাকায় ভয়াবহ আকারে প্রকাশ্য হলেও ওই সময়ও কারো বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভর্ৎসনা ও অসন্তোষ প্রকাশ আর উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে আপস-মীমাংসার ওপরই জোর দেয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এখনো কোন্দল নিরসনে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সব এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সমস্যা কতটুকু দূর করা সম্ভব হবে, তা নিয়েও দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকের মধ্যে সন্দেহ আছে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান মনে করেন, ‘কোনো পরিবারের মধ্যেও সমস্যা হয়। আওয়ামী লীগ একটা বড় পরিবার, এর মধ্যে মাঝেমধ্যে কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়। যেখানে সাংগঠনিক সমস্যা, সেখানে সাংগঠনিক সমাধান দেওয়া হচ্ছে।’

সূত্রমতে, মেয়াদ পার হওয়া কমিটি দিয়ে চলছে টানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ তৃণমূল। অনেক জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন নিয়মিত হচ্ছে না দ্বন্দ্বের কারণে। অনেক জেলার কমিটির নির্ধারিত সময় পার তো হয়েছেই, সঙ্গে এক যুগেরও বেশি কেটে গেছে। ফলে এসব এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যাশিত গতি নেই। কোথাও কোথাও সাংগঠনিক কার্যক্রম ঝিমিয়েও পড়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আশ্বাস পেলেও এলাকাগুলোর নেতাকর্মীরা নির্ধারিত সময়ে নতুন কমিটি পাননি। দলের আগামী কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই সারা দেশের তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্মেলন শেষ করার নির্দেশ সম্প্রতি দেয় আওয়ামী লীগ।

আসন্ন কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে তৃণমূলের সব কমিটির নির্বাচন বা দেশের সব এলাকায় সম্মেলন করা নানা কারণে সম্ভব নয় বলে মনে করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে দলের তৃণমূলকে যতটুকু সম্ভব গোছানোর জোরাল চেষ্টা চলছে। সময় কম হওয়ায় বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জেলার মেয়াদ পার করা ও দীর্ঘদিন সম্মলেন না হওয়া কমিটিগুলোর দিকে। সেসব জেলায় জরুরি বার্তায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে দ্রুত সম্মেলন করার। তৃণমূলের সম্মেলন করতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে কেন্দ্র থেকে পাঠানো চিঠি পেয়েছেন বলে বাংলাদেশের খবরকে নিশ্চিত করেন কয়েকটি এলাকার তৃণমূলের নেতা।

জানা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দূর করতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তেমন সুফল মেলেনি। সারা দেশে প্রায় শতাধিক সংসদীয় আসনে দলটির শত্রু ও প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। অনেকে নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ঘায়েল করতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখেন। অনেক এলাকায় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে উপজেলা চেয়ারম্যানদের। গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের তুলনায় একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে বিরোধ ছিল চরমে। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ও না-পাওয়াকে কেন্দ্র করে বিরোধ মাঠেও গড়ায়। উপজেলা চেয়ারম্যানরা সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না বলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। তবু অনেক জেলা ও উপজেলায় বিরোধ থামেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পৌর মেয়র ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা স্বপদে থেকে সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন না বলে আদেশ দেন উচ্চ আদালত। ফলে তখন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে চাপা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারেননি অনেকে। সংসদ নির্বাচনের আগে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্য কাউকে দল থেকে বের করে দেওয়া বা বড় সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সূত্রমতে, সংসদ নির্বাচনের পর তাদের কোন্দল আবার প্রকাশ্য হয়ে ওঠে পঞ্চম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। চলতি বছরের মার্চ থেকে পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের আগে দলীয় কোন্দল নিরসনে কঠোর উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবু সংসদ সদস্যদের সঙ্গে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় প্রকাশ্যে বিরোধের কারণে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীকে খেসারত দিতে হয়। তখনো দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। দলের নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হন অনেকে। বিদ্রোহী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে দেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে যারা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহীর কমিটিতে চূড়ান্ত হয়েছে। শোকের মাস আগস্টে এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে অভিযুক্তদের কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো শুরু হবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads